ফিরি বিশ্বজিতের ঘটনায়। লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, তার পিঠে মাত্র একটি বড় জখম ছিল। আর বা পা থেঁতলে গিয়েছিল। মৃত্যুর কারণ হিসেবে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। ময়নাতদন্তকারী অধ্যাপক মাকসুদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘বিশ্বজিতের পিঠের দিকের ওই কাটা জখম ছাড়া আর কোনও জখম পাওয়া যায়নি’। আজ তিনি কোনও কথা বলেন না। ফোন কল ধরে সাংবাদিক শুনে ফোন বন্ধ করে দেন। কেন? তার কাছে প্রশ্ন ছিল, বিশ্বজিতের ময়নাতদন্তে একটি কাটা দাগই কি ছিল? ফোন বন্ধ। এর উত্তর মিলবে কিনা জানি না, প্রশ্ন তোলা জরুরি।
প্রত্যক্ষদর্শীর জবান, বিশ্বজিৎ দাসকে প্রকাশ্যে কুপিয়েছিলেন সাত থেকে আটজন। তার শরীরে একের পর এক কোপের আঘাত লাগার ভিডিও এখনও আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। শরীর ভেসে যাচ্ছে রক্তে, ছেলেটা বাঁচতে চাইছে। তারপর কী হলো? পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে শরীরে একটি কাটা ও দুটি জখম এবং ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে একটি জখম। সেটি ২০১৩ সালের কথা হলেও ২০১৭ সালেও সেই সুরাহা হয় না। সিস্টেম।
আরেকটু আগে গেলে প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে কী মেলে? আইনজীবীদের মিছিল ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া ছাত্রদের একটি মিছিল মুখোমুখি হয়েছিল সেদিন। বিএনপির অবরোধ। তখন বিশ্বজিৎ দৌড়ে যেতে থাকলে হঠাৎই ২০-২৫ জন মিছিলকারী হাতে চাপাতি, রড, লাঠিসোঁটা নিয়ে ধাওয়া করে ভিক্টোরিয়া পার্কসংলগ্ন উত্তর পাশের পেট্রোলপাম্পের মোড়ে তাকে চাপাতি দিয়ে কোপ দেয়। প্রাণে বাঁচতে বিশ্বজিৎ পাশের একটি মার্কেটের দোতলায় উঠে যান। সেখানেও হামলাকারীরা তাকে এলোপাতাড়ি আঘাত করেন। বিশ্বজিৎ নিচে নেমে আসার পরেও তাকে আঘাত করে গুরুতর রক্তাক্ত জখম করা হয়। কিন্তু কাগজে কলমে একটি।
এভাবেই বদলে যায় ঘটনা। কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ১০ দিন পর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর পুনময়নাতদন্ত করতে হয়েছিল। সম্প্রতি বিশ্বজিতের অনেক পরে। এর আগে মির্জাপুর গ্রামের পারিবারিক কবরস্থান থেকে তনুর লাশ উত্তোলন করা হয়। লাশের দ্বিতীয় সুরতহাল রিপোর্টে তনুর হাতে-পায়ে ও গলার পেছনে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। অথচ প্রথম সুরতহাল রিপোর্টে যা উল্লেখ করা হয়নি। দুটি সুরতহালের মধ্যে এই গড়মিল হলো কী করে? আবারও প্রশ্নটা তোলা জরুরি, উত্তর মিলবেই।
ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনই কি শেষ কথা। তা না। কিন্তু এটি আশ্বস্ত করে। শুরুর প্রতিবেদন বলে, শেষবার শরীরটাকে এই রিপোর্টের মাধ্যমেই পাঠ করা হয় বলে, এটির ওপর মানুষের আদালতের এবং পরিবারের আস্থার জায়গা আছে। আর সেখানে যদি হয় গরমিল, তখন পুরো বিচারের যে চলমান রাস্তা সেখানে আরও খানাখন্দ তৈরি হয়। এতোগুলো জানাশোনার মধ্যেকার মামলার ক্ষেত্রে একই রকম ঘটনা শঙ্কার তৈরি করে।আরও ‘কেন’ প্রশ্ন সামনে এসে হানা দেয়। যে মানুষগুলো এই গুরু দায়িত্বের জায়গায় আছেন তারা কেন কোপের সংখ্যা সঠিক বলতে পারছেন না। কেন এবং কোন জায়গা থেকে নিজের প্রফেশনের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবেন কথা দিয়ে কাজে নেমেও খুঁজে পান না কিশোর প্রাণগুলো চলে যাওয়ার পেছনের আঘাতগুলোকে, কিভাবে প্রতিবেদনে মুছে যায় আঘাত। এই প্রশ্নগুলো উত্থাপন করলে দেখা যাবে, সেই ‘সিস্টেম’ তাদের আটকে রেখেছেন, নিজেকে নিরাপদ রাখতেও কখনও কখনও সেই ক্ষমতার কাছেই রোজ হেরে যাচ্ছে কিছু ‘নোবেল প্রফেশন’। একের পর এক মামলায় আদালতের রায়ে এই জায়গাগুলো ধরে প্রশ্ন করায় আগামীর টানেলের শেষ সীমানায় কিছু আলো কি দেখা যায়? সে আলো কি এতো অন্ধকার ঢাকতে পারবে?
লেখক: সাংবাদিক, বাংলা ট্রিবিউন