বাংলাদেশে বসবাসরাত প্রায় ৩০ লক্ষ ক্ষুদ্র-জাতিগোষ্ঠীর জনগণ এবং এদেশের প্রগতিশীল, সংবেদনশীল, এবং সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদে বিশ্বাসী মানুষ বেশ জাকজমকপূর্ণভাবে সারাদেশে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০১৭’ পালন করছে। আজ বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোকে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন পার্বত্যজেলায় আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছে। এসব অনুষ্ঠানে বহু বৈচিত্রময় আদিবাসী সংস্কৃতি উপস্থাপনের পাশাপাশি আদিবাসী অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র, বিশ্ব আদিবাসী দশক (প্রথম দশক ১৯৯৬-২০০৪ এবং দ্বিতীয় দশক ২০০৫-২০১৪), জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার সনদ, আদিবাসীদের অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কনভেনশন ১০৭ (১৯৫৭) ও ১৬৯ (১৯৮৯), এবং বাংলাদেশের আদিবাসীদের সাংবিধানিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ও বঞ্ছনার বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে। এবং পরের দিনই সবাই তাদেন ভুলে যাবে। এভাবেই প্রতিবছর বিশ্ব আদিবাসী দিবস বাংলাদেশে পালিত হয়।
বাংলাদেশে আদতে ‘আদিবাসী’ বলতে কাদেরকে বোঝায় এখনও পর্যন্ত সে বিতর্কই অমীমাংসিত রয়ে গেছে। আদিবাসী শব্দটির প্রকৃত সংজ্ঞা ও তাদের জাতীয় পরিচয় ও অধিকার নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে এবং সেটা অদ্যাবধি জারি আছে। আমি পত্রিকান্তরে লিখেছি, ‘জাতিসংঘের বিভিন্ন পর্ষদে ও বিভিন্ন পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার পরেও আদিবাসীদের ব্যাপারে সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য কোনও সংজ্ঞায় উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি বিধায় ‘সেলফ-ডেফিনিশন’ বা আদিবাসী জাতিসমূহের স্ব-সংজ্ঞায়নের হাতে আদিবাসী সংজ্ঞানের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে একটা মতৈক্য হয়েছে যে, সাধারণত কোনও একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অনুপ্রবেশকারী বা দখলদার জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্বে যারা বসবাস করত (এটা ঔপনিবেশিকতার অভিজ্ঞতার সাথে সম্পৃক্ত এবং আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) এবং এখনও করে; যাদের নিজস্ব ও আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে; যারা নিজেদের আলাদা সামষ্টিক সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যারা সমাজে সংখ্যালঘু হিসেবে পরিগণিত, তারাই আদিবাসী। অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে বসবাসকারী একদল জনগোষ্ঠী যারা সাংস্কৃতিকভাবে সংখ্যালঘু, যাদের নিজস্ব একটি সংস্কৃতি আছে যা জনতাত্ত্বিক সংখ্যাগুরুদের সংস্কৃতি থেকে স্বতন্ত্র এবং যাদের একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকর আছে এবং যারা রাষ্ট্রের কাঠামোয় সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক তারাই আদিবাসী হিসাবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে।’ এসব বিচার-বিশ্লেষণ করলে এটা সহজেই অনুমেয় যে, বাংলাদেশে বসবাসকারী সাঁওতাল, গারো, ওরাং, মণিপুরি, হাজং, পাত্র, জৈন্তা, খাসিয়া, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খেয়াং, খুমি, লুসাই, পাংখোয়া প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী ‘আদিবাসী’ হওয়ার দাবি রাখে। আমি পত্রিকান্তরে আরো লিখেছিলাম, ‘কিন্তু রাষ্ট্র একটি ভুল তাত্ত্বিক অনুসিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে ‘আদিবাসী আছে কী নাই’ তার নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বসে আছে। রাষ্ট্র যে জায়গাটায় ভুল করেছে সেটা হচ্ছে, ‘আদিবাসী’ আর ‘আদি বাসিন্দা’র মধ্যকার তফাৎ না-বুঝতে পারার ভুল। ‘আদিবাসী’ আর ‘আদি বাসিন্দা’ যে এক নয় এটা রাষ্ট্রবাদি চিন্তার কাঠামোই আমরা বহুচেষ্টা করেও ঢুকাতে পারিনি। এখানে মনে রাখা জরুরি যে, ‘ইন্ডিজেনাস’ শব্দের অর্থ ‘আদিবাসী’ যেটা একটি সাংস্কৃতিক ক্যাটেগরি আর ‘আরলিয়েস্ট মাইগ্রেন্টস’ অর্থ হচ্ছে ‘আদি বাসিন্দা’ যেটা একটি জনতাত্ত্বিক ক্যাটেগরি’। তাছাড়া, বাঙালিরা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠন করেছে এবং তারা বর্তমানে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে এদেশের আধিপতিশীল শ্রেণি। ফলে তারাই রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত যেখানে সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘু জনগণ, আদিবাসীরা, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে প্রান্তিক অবস্থানে। নিজেদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা নিয়ে প্রান্তিক অবস্থানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে যদি বিশ্বব্যাপি ‘আদিবাসী’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে বাংলাদেশে তাদের ‘আদিবাসী’ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে সমস্যা কোথায়?
এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, রাষ্ট্রের কাঠামো এবং সাংবিধানিক পরিভাষায় ‘বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নাই’। এমনকি সাংবিধানিক কাঠামোতে বাঙালি ছাড়া অন্য কোনও জাতিসত্তার মানুষকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে স্বীকারই করে না, কেন না বাংলাদেশের সংবিধানের আর্টিক্যাল ৬(২)-এ উল্লেখ আছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন’। অর্থাৎ বাঙালিরাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং বাঙালি ছাড়া ভিন্ন কোনও জাতির মানুষ (সাঁওতাল, গারো, মণিপুরি, ওরাং, মুন্ডা, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খুমি, ম্রো প্রভৃতি) বাংলাদেশের নাগরিক নন। তবে, সংবিধানের আটিক্যাল ২৩-এ গিয়ে এসব জাতিগোষ্ঠীকে জাতি হিসাবে নয় বরঞ্চ ভিন্ন নামে এক ধরনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বাঙালি ছাড়া ভিন্ন জাতিসত্তার যেসব মানুষ বাংলাদেশে বাস করে তারা রাষ্ট্রের ভাষায় ‘বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী, এবং সম্প্রদায়’ (বাংলাদেশ সংবিধান ২৩/ক) হিসাবে পরিচিত। অতএব, আজ যখন গোটা দুনিয়া বহুভাষাভাষী মানুষের এবং বহু সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের আদিবাসী মানুষদের যথাযথ মর্যাদা দিয়ে একটি আন্তর্জাতিক দিবস পালন করছে, তখন বাংলাদেশে তারা তাদের সাংবিধানিক এবং আইনি অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছে। নিজেদের আত্মপরিচয়ের এ সংকট আজকে নতুন নয়। একাত্তরে বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই তারা তাদের আত্মপরিচয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ৬(২) ধারায় বাংলাদেশকে যেমন ‘বাঙালির দেশ’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১১ সালের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ‘এদেশের নাগরিক বাঙালি বলিয়া গন্য হইবে’ বলে ‘অবাঙালি আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীকে সাংবিধানিকভাবে অস্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যার অর্থ দাঁড়ায় বিগত চার দশকেরও অধিক সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে সত্য কিন্তু ‘আদিবাসীদের’ স্বীকৃতি এবং অধিকার বিষয়ের রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির কোনও পরিবর্তন হয়নি। এরকম একটি বাস্তবতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে জাতিসংঘের ‘আদিবাসীর অধিকার ঘোষণার একদশক’কে বিবেচনা করতে হবে। অন্যথায় আদিবাসী সমাজের নিত্যদিনের বঞ্চনা, বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর বহুমাত্রিক অত্যাচার, ভূমি দখলের ক্রমবর্ধমান তৎপরতা এবং রাষ্ট্রীয় ও ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় আদিবাসী মানুষের অসহায় ও কষ্টকর জীবনের কোনও আসল চেহারা আমরা দেখতে পাবো না।
এখানে আরও মনে রাখার জরুরি যে, ‘আদিবাসীদের অধিকার ঘোষণার একদশক পূর্তি’ কেবল দশ বছরের হিসাবনিকাশ বিবেচনায় নিলেই হবে না। বিবেচনায় নিতে হবে দু’টি আদিবাসী দশক ও তার লক্ষ্যমাত্রা। জাতিসংঘের প্রথম আদিবাসী দশক ছিল ১৯৯৫-২০০৪ এবং দ্বিতীয় দশক ছিল ২০০৫-২০১৪। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রথম আদিবাসী দশকের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে মানবাধিকার, পরিবেশ, প্রতিবেশ, উন্নয়ন, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের যে সংকট ও সমস্যা আদিবাসী জনগোষ্ঠী মোবাবিলা করছিল তা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয় আদিবাসী দশকের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল, সক্রিয়তা এবং সম্মান সুনিশ্চিত করণের জন্য অংশগ্রহণের প্রতি গুরুত্বারোপ। কিন্তু বাংলাদেশে অবস্থানরত যাদের আমরা এখন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বলি তাদের ভূমি সমস্যা সমাধান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার, মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন তো দূরে থাক, ‘আদিবাসী’ হিসাবে নিজেদের এখনও স্বীকৃতি পর্যন্ত মেলেনি। এরকম একটি সামাজিক, এবং রাজনৈতিক বাস্তবতায় ‘আদিবাসী অধিকার ঘোষণার এক দশক পূর্তি’কে সামনে রেখে আদিবাসী দিবস উদযাপন কেবল একটা আনুষ্ঠানিকতার অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছু নয়। একটা ফি বছরের ‘রিচুয়ালস’ ছাড়া কিছুই নয়। যেদিন এ রাষ্ট্র আদিবাসীদের যথাযথ স্বীকৃতি দিয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজেদের আত্মপরিচয়ের পরিচিত হওয়ার সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করবে, সেদিনই সত্যিকার আদিবাসী দিবস উদযাপিত হবে। আমরা সেদিনের অপেক্ষায় থাকলাম।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।