উপরের গল্পটি ভূমিকায় এজন্য বলা যে, সম্প্রতি বাংলাদেশের অনলাইনে ঘটেছে তিন তিনটি ঘটনা, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে বেশ গরম করে রেখেছিল এবং এক-দুইটি এখনও স্তিমিত হলেও চলমান। প্রতিটি ঘটনাই সর্বোচ্চ ভাইরাল হয়েছে। সচেতন অথবা অবচেতন মনে, যেভাবেই হোক না কেন, লক্ষাধিক মানুষ যে এই গুজবের সাগরে গা ভাসিয়েছেন, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়!
প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল সাকিব আল হাসানের তোলা কোনও এক বিয়ের দাওয়াতে একটি ছবিকে নিয়ে। ছবিতে দেখা যায় যে, সাকিব একটি টেবিলে বসে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে খাচ্ছিলেন। তার ঠিক পেছনেই গৃহকর্মী দাঁড়িয়ে ছিলেন। ছবিটি সিম্বলিক অর্থে এভাবে অত্যন্ত অমানবিক হয়ে ওঠে যে, ‘বাড়ির মনিবরা তাদের সহকারীকে অভুক্ত রেখে নিজেরা লোভনীয় খাবারগুলো খাচ্ছেন। কিছুটা দূর থেকে দাঁড়িয়ে থেকে অভুক্ত সহকারী করুণ চোখে তা দেখছে’। সারা ফেসবুকের ভেতর-বাইরে রি রি পড়ে যায় ঘৃণায় ও প্রতিবাদে। বিশ্বের এক নম্বর ক্রিকেট তারকাকে সবাই আবিষ্কার করেন অমানবিক মানুষ হিসেবে। লাগামহীন ভাষায় অনবরত ছুড়তে থাকে হিংসাত্মক নোংরা কথা। এমন আক্রমণাত্মক কথা থেকে রেহাই পান না তার স্ত্রীও। সাকিবের ব্যাপারে মানুষের এত ঘৃণা জমে ছিল কল্পনাও করা যায় না। অথচ এই সাকিব দেশ ও জাতীর জন্য বয়ে এনেছেন আন্তর্জাতিক সমীহ ও প্রশংসা। যাই হোক, সাকিবের স্ত্রী তার ফেসবুকের পাতায় যখন আরও কিছু ছবি দিয়ে জানিয়ে দিলেন যে, পরিবারের গৃহকর্মী মূলত কিছুক্ষণ আগেই খেয়ে ওঠে গিয়ে সাকিবের পেছনে দাঁড়িয়ে অনেকটা ছবিতে পোজ দেওয়ার মতই দাঁড়িয়েছিল। তখন ভুল শুধু ভাঙেনি, সবাই একযোগে রণে ভঙ্গ দিতেও বাধ্য হয়েছিল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল, এই নোংরা কৃতকর্মের জন্য একজন মানুষও প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করেনি বা ক্ষমা চায়নি।
দ্বিতীয় ঘটনাটি রুবি নামের এক মহিলার করা ‘ফেসবুক লাইভ’ ভিডিওটি ভাইরাল হওয়াকে নিয়ে। আমার খুব অবাক লেগেছে দেখে যে, আমার ফেসবুক বন্ধুদের খুব কমই ছিলেন যারা এই ভিডিওটি তাদের নিজ নিজ ওয়ালে শেয়ার দেননি। দেখা যাক, কী ছিল সেই ভিডিওতে। ভদ্রমহিলা রুবি বাংলাদেশে স্মরণকালের সবচেয়ে প্রতিভাবান ও জনপ্রিয় প্রয়াত চিত্রনায়ক সালমান শাহ’র মৃত্যুর ব্যাপারে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কিছু তথ্য দিয়েছেন। অনেকেই হয়ত জানেন, এই ক্ষণজন্মা চিত্রনায়ক যখন মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তখন তার মৃত্যুকে ঘিরে বেশ রহস্যের সৃষ্টি হয়েছিল। অনেক ধরনের গল্পের ডালপালা তখনও গজিয়েছিল। কিন্তু কোনও ধরনের অপমৃত্যুর আলামত তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা খুঁজে বের করতে পারেনি। এত বছর পর রুবি এসে সালমান শাহর অপমৃত্যুর ব্যাপারে কিছু তথ্য হাজির করেন তার ভিডিও'র মাধ্যমে। সেই থেকে শুরু হয় বিভিন্ন গুঞ্জন আর প্রশ্ন তোলা। কেউ কেউ তো অনেকটা আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিভিন্ন জনকে শাস্তি দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। কার দোষে ও প্ররোচনায় সালমান শাহর মৃত্যু হয়েছিল, তার কঠিন কঠিন থিওরি এক এক করে হাজির হতে থাকলো ফেসবুকের নিউজ ফিডে। এভাবেই আলোচনা-সমালোচনার ঝড়ের মধ্যে দিয়ে কেটে যায় প্রায় চারটি দিন। এরপর সেই রুবিই আবার ফিরে আসেন। তিনি এবার নতুন তত্ত্বভিত্তিক ভিডিও বাণী দেন। রুবি দাবি করেন, তিনি নাকি মানসিক ভারসাম্যহীন একজন মানুষ, যার কথাবার্তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। এমনকি তিনি চ্যালেঞ্জও দিয়ে বসেন যে, তিনি যে ভারসাম্যহীন মানসিকরোগী, তা তিনি প্রমাণও করতে পারবেন। বিষয়টি এমন দাঁড়ালো যে, একইসঙ্গে রুবি নিজেই বিচারক, আসামি আবার উকিলও। এরপর কী হলো? সোশ্যাল মিডিয়ায় এক এক করে সবাই হতাশা প্রকাশ করা শুরু করলো।
তৃতীয় ঘটনাটি বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী আব্দুল জব্বারকে নিয়ে। বর্তমানে তিনি কঠিন ব্যাধির কারণে চিকিৎসাধীন, যা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ ও জটিল। আব্দুল জব্বার যে অসুস্থ, তা গণমাধ্যমের মাধ্যমে ইতোপূর্বেই সারাদেশ জেনে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তার চিকিৎসার জন্য নগদ ২০ লাখ টাকা দেওয়া ছাড়াও বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এসবের মধ্যেই কিছু অখ্যাত অনলাইন পত্রিকা তার আর্থিকভাবে অসামর্থতার কথা জানিয়ে লিখেছে যে, জব্বার সাহেব নাকি বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছ থেকে ‘এক টাকা’করে সাহায্য চেয়েছেন তার চিকিৎসার খরচ চালানের জন্য। মিডিয়াগুলো খবরটিকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য রঙ ছড়িয়ে এও লেখে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই শিল্পীর গাওয়া গানগুলোর প্রতিদানস্বরূপ এই সাহায্যের মিনতি জানিয়েছেন। এমন একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা এবং একজন অত্যন্ত প্রতিথযশা মুক্তিযোদ্ধাশিল্পীর করুণ আকুতির কথা অনলাইন মাধ্যমগুলোতে এক বিষাদের ছায়া ফেলে দেয়। জনপ্রিয়তার দৌড়ে পাল্লা দিতে গিয়ে সোর্সের কথা উল্লেখ না করেই দেশের বেশকিছু শীর্ষস্থানীয় অনলাইন পত্রিকা একই নিউজ ফলাও করে প্রকাশ করে। মিডিয়াগুলোর এই দায়িত্বহীনতার কারণে ভুক্তভোগী ব্যক্তি এবং তার পরিবারকে জনসমক্ষে পড়তে হয় এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে। তারা লজ্জিত হন। তখন বাধ্য হন তারা মিডিয়া ডেকে বলতে যে, এই ধরনের কোনও আবেদন তারা বা তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ করেননি। সেই একই অবস্থা। অনেক নিন্দুক এরই মধ্যে শিল্পী আব্দুল জব্বারের নীতি-নৈতিকতা এবং রোগের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কতশত প্রশ্ন তুলে ফেলেছেন, তার হিসাব নাই। অথচ এই গুজবের জন্য কোনও মিডিয়া দুঃখপ্রকাশ তো দূরের কথা, মিথ্যা খবর প্রকাশের জন্য আলাদাভাবেও কোনও খবর প্রকাশ করার প্রয়োজনবোধ করেননি।
এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে, মানুষ কেন গুজবে কান দেয় বা গা ভাসাতে পছন্দ করে। বিশ্লেষকরা অবশ্য তাদের মতো করে বিভিন্ন কারণ বা তত্ত্ব তুলে ধরেছেন এ ব্যাপারে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণটা হচ্ছে, ‘মানুষ তাই বিশ্বাস করে, যা তাকে ভাবায়।’ অর্থাৎ মানুষের গভীরে যে অবচেতনজনিত দ্বন্দ্ব, তা মানুষের গভীরেই থাকে গোপনে। নৈর্ব্যক্তিক চেতনায় খুব কমই তার ভাষা পায়। যেমন, কেউ যদি ক্ষুধার্ত পেটে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, অবচেতন মনেই সে রাস্তার দু’পাশের সারিবদ্ধ দোকানগুলোকে খাবারের রেস্টুরেন্ট ভেবে ভুল করে। অর্থাৎ ‘গুজব’বা ‘অসমর্থিত সূত্রের কোনও কথাকে’ মানুষ খুব সহজেই আমলে নেয় বা মননে বিশ্বাস করতে সায় জাগায়, যখন তার মনের গভীরের গোপন কুটিরে পূর্বগচ্ছিত একই ধরনের বা ঘরানার ভাবনা সঞ্চিত বা সংরক্ষিত থাকে!
১৯৭২ সালের ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা, যার সঙ্গে উল্লিখিত চলমান ঘটনাগুলো অত্যন্ত সামঞ্জ্যস্যপূর্ণই শুধু নয়, হতাশাব্যঞ্জকও বটে! পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর যারা প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন, স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের টুঁটি চেপে ধরে বন্দুকের নলের আগায় বধির বানিয়ে রেখেছিল বছরের পর বছর। প্রতিবাদের এই দীর্ঘ নিঃশব্দতার আড়ালে ব্যাংক ডাকাতিসহ আরও অনেক মুখরোচক মিথ্যের বেসাতিতেপূর্ণ রটনাকে বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত করেছিল স্বাধীনতাবিরোধীরা। প্রপাগান্ডার পাখায় উড়িয়েছিল সেই মিথ্যে গুজবগুলো বাংলার ঘরে ঘরে। স্বাধীনতাবিরোধীদের মিথ্যাচার এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে 'হিটলারের গোয়েবলস’ও হয়ত জীবিত থাকলে লজ্জা পেতেন। গোয়েবলসের থিওরি ছিল, 'একটি মিথ্যাকে ১০০ বার বললে তা সত্য হয়ে যায়'। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি বিজয়ী হয়ে গোয়েবলসকে শাস্তি ঠিকই দিয়েছে, কিন্তু তার থিওরিকে কিন্তু সাদরে গ্রহণ করেছিল, যা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছিল বিরামহীনভাবে। গোয়েবলসের থিওরিকে একাত্তরবিরোধীরা এমন এক অভূতপূর্ব সংস্কৃতিতে রূপ দিয়েছে যে, তা এখন সারাদেশের জনগোষ্ঠীর মগজ ধোলাইয়ের কাজে শুধু ব্যবহারই হয় না, একইসঙ্গে মানুষের চিন্তাশক্তিকে নিজস্বার্থে প্রভাবিত করতেও কৃচ্ছতাবোধ করে না। গোয়েবলস বেঁচে থাকলে হয়ত করজোড়ে ঈশ্বরকে বলতেন, 'প্রভু, আমি আর কত দিন একাত্তরের এই নরপশুদের মিথ্যের বেসাতি হয়ে রইবো!
খুব দুঃখ হয় ভেবে যে, ১৯৭২ সালে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক-টুইটারের কেন জন্ম হয়নি। হলে হয়ত শেখ কামালের জন্যও কেউ কিছু কথা বলতো! আফসোস হয় বাংলার এই রত্নকে নিয়ে যারা এখনও গুজবের পাখায় ভর করে নোংরা আকাশে ওড়ে। স্বাধীনতার ছেচল্লিশ বছর পরে এসেও বাংলাদেশের জন্মদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর তার পরিবারকে এখনও এইসব গুজবের প্রতিউত্তর দেওয়ার জন্য আমাদের প্রজন্মকে কলম ধরতে হয়! এ জাতি সত্যিই খুব অভাগা। আখেরে মাথা পেতে মেনে নিতেই হয়, আমরা মূলত 'কু-জনের গুজব ও গুঞ্জনে' তৈরি হওয়া খাঁটি বাঙালি!
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা