বেনজির হত্যার প্রকৃত বিচার কখনোই হবে না

আনিস আলমগীর২০০৭ সালে ২৭ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডির লিয়াকত বাগের বাইরে এক নির্বাচনি জনসভায় পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং পিপলস পার্টির প্রধান বেনজির ভুট্টো আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। নির্বাচনি সমাবেশ শেষে সভাস্থল ত্যাগ করার পর গাড়িতে আরোহণের পর মুহূর্তে আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন তিনি। একজন আততায়ী বেনজির গাড়িতে ওঠার পর তার ঘাড়ে এবং কাঁধে গুলি করে।
পিণ্ডি ফৌজিদের এলাকা। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর আরেক জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানও আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। বর্তমান যেটি লিয়াকত বাগ সেখানেই তিনি জনসভা করতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন। লিয়াকত আলী খানের হত্যার কোনও বিচারই হয়নি। বেনজিরের হত্যার তবুও একটা বিচার হয়েছে, যদিও বিচারের আগা-মাথা নেই।
বিচারের রায়ে পিণ্ডি পুলিশের দুই উচ্চপদস্থ সদস্যকে ১৭ বছর করে কারাদণ্ড এবং সাবেক সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফকে ‘পলাতক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে অন্য পাঁচজন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে, যারা ছিল পাকিস্তানি তালেবান। পুলিশকে যেভাবে দায়িত্ব অবহেলার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে, পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে তেমন কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগও আনা হয়নি, সাজাও দেওয়া হয়নি। পলাতক লোকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা- এগুলো বিচারিক প্রক্রিয়া। মোশাররফের ক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছে।

রায় প্রত্যাখ্যান করেছেন বেনজিরের ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো। বিলাওয়াল দেশটির প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে বেনজিরের মেয়ে আসিফা ভুট্টো বলেছেন, ‘পারভেজ মোশাররফ তার অপরাধের জন্য জবাবদিহি না করা পর্যন্ত ন্যায় বিচার নিশ্চিত হতে পারে না’। মোশাররফ এখন আরব আমিরাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

পাকিস্তানের সামরিক আমলারা লিয়াকত আলীর হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসায় ষড়যন্ত্র আরম্ভ করেছিলেন। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় আসা শুরু করে। এয়ার মার্শাল আসগর খান তখন বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন। তিনি তার লেখা ‘জেনারেলস ইন পলিটিক্স’ বইতে এ সম্পর্কে বহু কাহিনির বর্ণনা দিয়েছেন। রৌমারী বিমানবন্দরে আসগর খানই আইয়ুবের হুকুমে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট জেনারেল (অব.) ইস্কান্দার মির্জা ও তার স্ত্রী নাসিম মির্জাকে লন্ডনগামী বিমানে তুলে দিয়েছিলেন।

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত এই জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা, জেনারেল আইয়ুব খান, গোলাম মোহাম্মদ, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, চৌধুরী জাফরউল্লাহ খান- এই গ্যাং অব ফাইভ- সামরিক ও বেসামরিক আমলাই পাকিস্তানের ক্ষমতার খেলার মূখ্য খেলোয়াড় ছিলেন। আইয়ুব খান পিণ্ডি ষড়যন্ত্র মামলার পর থেকেই পাকিস্তানের প্রধান সেনাপ্রধান ছিলেন। আবার লিয়াকত আলী খানের মন্ত্রিসভা ছাড়া অন্য সব মন্ত্রিসভায় আইয়ুব সেনা প্রধানের পাশাপাশি প্রতিরক্ষামন্ত্রীও ছিলেন।

১৯৫৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর আইয়ুব যে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো সেই মন্ত্রিসভার কনিষ্ঠতম মন্ত্রী ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে এ কে খান এবং বিচারপতি ইব্রাহিম আইয়ুবের প্রথম মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ছিলেন। জুলফিকার আলীর ভুট্টোর পরিবার সিন্ধুর কোনও রাজনৈতিক পরিবার ছিল না। তার বাবা শাহনেওয়াজ ভুট্টো ছিলেন লারকানার জমিদার। সিন্ধুর রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল আইয়ুব খুরু আর আবদুল মজিদ সিন্ধির নিয়ন্ত্রণে। তাদের প্রভাব থেকে সিন্ধুকে মুক্ত করার জন্য আইয়ুব খান হাতে ধরে ভুট্টোকে রাজনীতিতে তুলে এনেছিলেন এবং ভুট্টো পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন আইয়ুবের আশির্বাদপুষ্ট হয়ে।

ভুট্টোর বিদ্যা বুদ্ধি ছিল। বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি থাকার পরও অন্তিম বিচারে এটা বলা যায় যে, ভুট্টোর কোনও আদর্শ ছিল না। নীতিবোধের প্রতি কোনও আনুগত্য ছিল না। কথার ফুলঝুড়িতে বাজিমাত করার প্রয়াসে তিনি সব সময় সক্রিয় থাকতেন। তাসখন্দ ডিক্টারেশনের সময় তিনি আইয়ুবের সঙ্গে একমত না হয়ে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন এবং ‘রুটি রুজি অউর মোকাম’- এই স্লোগান তুলে মানুষের আবেগে ঘা দিয়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টি গঠন করেছিলেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ৮৮টি আসন পেয়েছিল এবং আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ১৬২টি আসন। আওয়ামী লীগ তাদের সব ক’টি আসন পেয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে আর পিপিপি তাদের সব আসন পেয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। ভুট্টো এই সুযোগে দুই মেজরিটি পার্টির তত্ত্ব এবং দুই প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের ২০ বছরের হাল হকিকত দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে পাকিস্তানিদের সঙ্গে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই তারা ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দিয়েছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতার বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠেন বলা চলে। যে কারণে সত্তরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এই অঞ্চলের ১৬৪ আসনের ১৬২টিতে আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে দিয়েছিল।

নির্বাচনের পর ভুট্টোর দুই প্রধানমন্ত্রী তত্ত্ব আওয়ামী লীগকে স্বাধীনতার প্রশ্নে আরও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে উৎসাহ জুগিয়েছিল। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার প্রস্তুতিও সম্পন্ন করে রেখেছিল। এই কারণে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের বিপর্যয়ের জন্য ভুট্টোকে দায়ী করে থাকে। কতটুকু সত্য জানি না পাকিস্তানে একটি কথা প্রচারিত আছে যে ১৯৭৯ সালে ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলানোর আগেই সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পিটিয়ে মেরেছিল।

২০০৭  সালে নিহত হওয়ার আগেও বেনজির ভুট্টো দুই বার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কিন্তু কোনও বারই মেয়াদপূর্ণ করতে পারেননি। দুর্নীতির অভিযোগে তার মন্ত্রিসভা বাতিল করেছিলেন প্রেসিডেন্ট। ভুট্টোর এক ছেলে প্যারিসে নিহত হয়েছিল। আরেক ছেলে নিহত হয় করাচিতে। সম্ভবত ভুট্টোর পরিবারকে পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসতে না দেওয়াই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কঠিন সিদ্ধান্ত। সুতরাং যে কোনও বিচারে জেনারেল মোশাররফকে শাস্তি দেওয়া কঠিন কাজ হবে বলে মনে হয়। কারণ মোশাররফ মিলিটারিদের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করেছিলেন। তাই মোশাররফকে রক্ষা করা এখন সামরিক চক্রের দায়িত্ব।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান হারানোর ব্যাপারে যত না অনুতপ্ত তারচেয়ে বেশি অনুতপ্ত রেসকোর্স ময়দানে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার হাতে আত্মসমর্পণ করার ঘটনায়। তারা এই বিপর্যয়ের জন্য সম্পূর্ণভাবে ভুট্টোকে দায়ী করে। এই সামরিক চক্র ভুট্টোকে তাই ফাঁসি দিয়েছিল পুরনো এক হত্যা মামলা পুনর্জ্জীবিত করে।

ভুট্টোর সঙ্গে দ্বিতম করে পিপিপি ছেড়েছিলেন রাজা কাসুরী। রাজা কাসুরীকে নাকি হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন ভুট্টো। কিন্তু তার গাড়িতে যখন আততায়ীরা গুলি করে তখন কাসুরীর পরিবর্তে তার বাবার গায়ে গুলি লাগলে তিনি নিহত হন। এই হত্যা মামলায় ভুট্টো হুকুমের আসামি ছিলেন। এটাকেই পুনর্জ্জীবিত করেছে সামরিক বাহিনী।

বেনজির ভুট্টো তার আত্মজীবনী ‘ডটার অব দ্য ইস্ট’-এ লিখেছেন, ‘আমি এ জীবন বেছে নেইনি, জীবনই বেছে নিয়েছে আমাকে’। তার জীবন রাজনীতি বেছে নিয়েছিল তার পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। প্রতিশোধ স্পৃহা পাকিস্তানিদের জীবনকে সব সময় অস্থির করে রাখে। সিন্ধু থেকে সীমান্ত প্রদেশ পর্যন্ত সর্বত্র পাকিস্তানিরা প্রতিশোধ প্রবণ। কিন্তু বেনজির তার পিতা হত্যার প্রতিশোধতো নিতেই পারেননি বরং নিজেই হত্যার শিকার হয়েছেন- যার প্রকৃত বিচার পকিস্তানে কখনোই হবে না।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

anislamgir@gmail.com