আওয়ামী লীগকেই আওয়ামী লীগের ভয়!

বিভুরঞ্জন সরকারআওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রতিদিন নানা উপলক্ষে কথা বলেন। টেলিভিশন চ্যানেলে তা প্রচার হয়। আমাদের তা দেখতে ও শুনতে হয়। কখনও তার কোনও কথা ভালো লাগে। আবার কখনও বিরক্ত লাগে। কিন্তু তার তো কথা না বলে উপায় নেই। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা সম্ভবত তার একটি রুটিন রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দায়িত্ব। আওয়ামী লীগে যেমন তিনি, বিএনপিতে তেমনি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। তাদের টিভি পর্দায় দেখে আমার কেবলই মনে হয়, এত বলে যাই, তবু না ফুরায়, কথাতো হয় না শেষ! আরও একটি পুরনো দিনের গানের কথাও মনে হয়: কত যে কথা ছিল, কত যে ছিল গান...।
তো, ওবায়দুল কাদেরের একটি কথা আমার বেশ মনে ধরেছে। সম্প্রতি কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের এক সভায় তিনি যা বলছেন তা হুবহু উদ্ধৃত করতে পারছি না। তবে তার বক্তব্যের মর্মার্থ হলো, তিনি বিএনপিকে ভয় পান না, তার ভয় আওয়ামী লীগকে। আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গেই তিনি এই কথাটি বলেছেন। আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে ভয় না পেয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজের দলকেই কেন ভয় পাচ্ছেন? যারা রাজনীতির সামান্য খোঁজখবরও রাখেন তাদের কাছে এটা অজানা নয় যে সারা দেশেই এখন আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনও জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগ আর এক আছে বলে মনে হয় না। এক আওয়ামী লীগে কত যে ভাগ। উপদলীয় কোন্দলে আওয়ামী লীগ ক্ষত-বিক্ষত। মুখে যদিও বলা হয়, তারা সবাই বঙ্গবন্ধুর সৈনিক, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী কিন্তু বাস্তবে তারা অনুসরণ করেন স্থানীয় কোনও না কোনও নেতাকে।

আগে নির্বাচন এলে আওয়ামী লীগে কোন্দল বেশি দেখা যেত। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে একজন আরেক জনের বিরুদ্ধে এমন বিষোদ্গার করতেন, যা শুনলে মনে হতো না তারা এক আদর্শ বা এক নেতার অনুসারী। যিনি মনোনয়নলাভে বঞ্চিত হতেন তিনি উঠেপড়ে লাগতেন মনোনীত প্রার্থীর বিরোধিতায়। তাকে না হারাতে পারলে প্রমাণ হবে কী করে যে মনোনয়ন দান সঠিক ছিল না? সেজন্য তখন বলা হতো আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের শত্রু। এখন বিরোধ আর কেবল নির্বাচনকে ঘিরে হয় না। এখন এটা সারা বছরের ব্যাপার। আওয়ামী লীগের কলহ-কোন্দল সংঘাতে রূপ নিচ্ছে। আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। প্রায় প্রতিদিনের সংবাদপত্রেই এ বিষয়ে খবর থাকছে। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত আট বছরে ( ২০০৯—২০১৬) অভ্যন্তরীণ কোন্দলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অন্তত ১৮০জন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। বছরে গড়ে ২৫ জন। নিজেদের মধ্যে সহিংস ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ১২১টি। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আওয়ামী লীগ, এর সহযোগী ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে ৬৩ বার সংঘাতে জড়িয়েছে। এসব সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন ১১ জন। আহত হয়েছেন হাজার খানেক।

সহিংসতা আমাদের রাজনীতির পুরনো ব্যাধি হলেও আগে এটা হতো প্রতিপক্ষের সঙ্গে। খুব ব্যাপক আকারের না হলেও এক দলের কর্মী-সমর্থকরা অন্য দলের কর্মী-সমর্থকদের ওপর চড়াও হতো। মারামারি-হানাহানিতে আহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও নিহত হওয়ার ঘটনা ছিল বিরল। হকিস্টিক, লাঠি, ছুরি, চাকু থেকে রাজনৈতিক মাস্তানদের হাতে যখন আগ্নেয়াস্ত্র ওঠে, তখন থেকেই পরিস্থিতি বদলে যায়। একজন নিরস্ত্র মানুষ এবং একজন সশস্ত্র মানুষের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের জন্য খুব বড় গবেষক হওয়ার প্রয়োজন হয় না। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল কিংবা সাংগঠনিক ভাবে শক্তিশালী ছিল, তখন আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্য সংঘাত-সংঘর্ষ হতো। মূলত আধিপত্য বিস্তারের জন্যই সেসব হতো। ইসলামী ছাত্র শিবির অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য গলা কাটা, রগ কাটার রাজনীতি চালু করেছিল। 

এখন দেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দলের খুব বেশি প্রভাব কিংবা তৎপরতা নেই। বিএনপিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলছেন, ‘বাংলাদেশ নালিশ পার্টি’। অর্থাৎ নালিশ জানানো ছাড়া বিএনপির আর কিছু করার ক্ষমতা আপাতত নেই। তারা তাদের শক্তির অপব্যবহার করেছে, অপচয় করেছে। এখন বিএনপিকে সরকার তথা আওয়ামী লীগ ভয় পাচ্ছে না। এমন কী পরবর্তী নির্বাচনেও বিএনপিকে হিসেবে নিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের এই মনোভাব অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যথাযথ বলে মনে করেন না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কখনও দুর্বল ভাবতে নেই। নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে দেশের রাজনৈতিক সিনারিও বদলে যাবে। ঘুমন্ত বিএনপি জেগে উঠবে। নীরব সমর্থকরা সরব হয়ে উঠবে। তাছাড়া দেশে একটা জনরব চাউর হচ্ছে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না! কারা, কী উদ্দেশে এমন প্রচারণা ছড়াচ্ছে সে বিষয়ে আওয়ামী লীগের খোঁজখবর করা উচিত।

কিন্তু আওয়ামী লীগের একশ্রেণির নেতা-কর্মী এখন ক্ষমতামাতাল হয়ে উঠেছেন। বিএনপি মাঠে নেইতো কী হয়েছে, তারা নিজেরাই নেমে পড়েছেন ময়দান দখলে। বিএনপি বলছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেওয়া হবে না। আবার আওয়ামী লীগের মধ্যেও এমন মনোভাব আছে যে, মাঠ তো আর ফাঁকা থাকতে পারে না। এখন তাই আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হচ্ছে। মারামারি- হানাহানি করছে। নির্বাচনের সময়ও এটা অব্যাহত থাকলে সত্যি সত্যি আওয়ামী লীগকেই ভয় পেতে হবে আওয়ামী লীগকে।

আওয়ামী লীগে কার সঙ্গে কার দ্বন্দ্ব, কে কার লোক– সেটা কিন্তু কোনও গোপন ব্যাপার নয়। সবাই জানে। কেন্দ্রীয় নেতারাও জানেন। কিন্তু দ্বন্দ্ব নিরসনের কোনও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয় না। ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর আশা করা হয়েছিল তিনি হয়তো সংগঠন গোছানোর কাজে হাত দেবেন। আওয়ামী লীগ এবং সরকারের পৃথকীকরণ ঘটবে। দল যে সরকারে বিলীন হয়ে গেছে তা থেকে দলকে মুক্ত করা হবে। সরকার দল চালাবে না, দল চালাবে সরকার। প্রায় বছর খানেক হতে চললো দলের ভেতর আগাছা নিড়ানোর কাজে কোনও সাফল্য নেই। ওবায়দুল কাদের ছোটিছুটি করছেন। তার ফল দেখা যাচ্ছে না। তিনি একাধিক বার চট্টগ্রাম গিয়েছেন। সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ এবং বর্তমান মেয়র নাসিরুদ্দিনের বিরোধ কি তাতে একটুও কমেছে? তারা ঘোষণা দেন একটা করেন আরেকটা। আগামী নির্বাচনেও এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে ফসল ঘরে তুলতে বিএনপির খুব কষ্ট হবে কি?

কেউ কেউ মনে করেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব কলহ বিরোধ এখন এক নিরাময়অযোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কোনও টোটকা চিকিৎসা আর কাজ দেবে না। আবার ঝুঁকি নিয়ে কঠোর শল্য চিকিৎসা চালানোর কোনও আগ্রহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের আছে বলে মনে হয় না। 

দুই.

চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, চালে দাম বাড়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু তারপরও বাড়ছে। মন্ত্রী বলছেন, চাল নিয়ে চালবাজি চলছে। কারা করছে এই চালবাজি? তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? চালকল মালিক ও বড় চাল ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে কারসাজি করে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। এই মুনাফালোভীদের বিরুদ্ধে সরকার কোনও ব্যবস্থা নিতে পারছে না। চাল ব্যবসায়ীদের দুই শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েও তা কার্যকর করা যায়নি। উল্টো তাদের সঙ্গে তিন মন্ত্রী বৈঠক করেছেন, তাদের হুমকিধমকি হজম করেছেন। একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে সরকার, দেশের মানুষ জিম্মি– এ কি স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া যায়? 

চাল রাজনীতি কিন্তু বাংলাদেশের জন্য খুব নাজুক বিষয়। চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে গেলে মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। চাল না পেলে মানুষ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। মানুষের চাল-সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগানোর জন্য সরকারবিরোধীরা মাঠে নেমে পড়েছে। প্রচার করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ নাকি ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়ানোর অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসেছে। আর এখন বাজারে চালের দাম ৬০/৬৫ টাকা কেজি! এই প্রচারণা মানুষকে উত্তেজিত করার জন্য খুব সহজ হাতিয়ার। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি সত্যি ১০ টাকা কেজি দরে চাল দিতে চেয়েছিল? আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে এমন কোনও অঙ্গীকার খুঁজে পেলাম না। তাহলে এই কথাটা এলো কোত্থেকে এবং কিভাবে? আওয়ামী লীগকে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত।

খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রসালো সব আলোচনা হচ্ছে। এরমধ্যে কিছু সিরিয়াস কথাও কেউ কেউ বলছেন। কামরুল ইসলামকে খাদ্য মন্ত্রী রেখে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বলে অনেকেই মনে করেন। কারণ তিনি নিজের মন্ত্রণালয় নিয়ে যত সময় দেন তারচেয়ে বেশি সময় দেন বক্তৃতাবাজিতে। চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পারেন না, লড়তে যান প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে। আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত এবং দণ্ডিত হয়েও তিনি কিভাবে মন্ত্রী পদে বহাল আছেন এবং তার জন্য সরকারের কোন সুনাম বেড়েছে– এসব প্রশ্ন সামনে আসছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল যখন মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আছড়ে পড়ছে, তখন কামরুল চাল কেনার জন্য মিয়ানমার গিয়ে দেশের মানুষের মর্যাদাবোধে আঘাত করেছেন। তাকে খাদ্যমন্ত্রী রাখার পক্ষে যুক্তি কী তা এখন আমাদের জানতে চাইতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর পরিশ্রম করে দেশের জন্য সাফল্য ও সুনাম বয়ে আনবেন– আর কামরুল ইসলামের মতো মন্ত্রীরা সেই অর্জন ধুলায় লুটিয়ে দেবেন –এটা কি মেনে নেওয়ার মতো বিষয়? 

লেখক: কলামিস্ট