‘রাজনৈতিক দুর্যোগ’ ও বাঙালিমানস

চিররঞ্জন সরকারবাংলার আকাশে’যে কবে প্রথম ‘দুর্যোগের ঘনঘটা’ শুরু হয়েছিল, তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে অনুমান করা যায়, অনাদিকাল থেকেই এখানে ‘দুর্যোগের ঘনঘটা’চলছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এত দুর্যোগের পরও কিন্তু দেশটা ধ্বংস হয়ে যায়নি! পরিস্থিতি দিনকে দিন ‘খারাপ’, ‘অতি খারাপ’, ‘মারাত্মক খারাপ’ হয়েছে ও হচ্ছে; তারপরও কিন্তু দেশটা দিব্যি টিকে আছে। এত দুর্যোগের পরও দেশের লোকসংখ্যা কমেনি। পরিবার পরিকল্পনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সড়ক দুর্ঘটনা, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু, লঞ্চ ডুবে মৃত্যু, সন্ত্রাসীদের হাতে মৃত্যু, দারিদ্র্য, অপুষ্টি, রোগ-শোক কোনও কিছুই জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতিকে থামাতে পারেনি। অথচ ‘ক্রান্তিকাল’ বা ‘দুর্যোগের ঘনঘটা’ চলছেই।
ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি–দিনকাল খুব খারাপ। চারদিকে উত্তেজনা, মারামারি-কাটাকাটি-ফাটাফাটি, হিংসা, খুন, সন্ত্রাস, দলাদলি, ব্যাভিচার, মৌলবাদি তাণ্ডব। এসবের ফল একটাই–দিনকাল খুব খারাপ। এই দিনকাল খুব খারাপ যে কত দীর্ঘ যে কত বড়, তা সম্ভবত কেউ জানে না। দিন যতই যাচ্ছে, পরিস্থিতি ততোই খারাপ হচ্ছে। সমাজে অস্থিরতা, ভয়, আতঙ্ক বাড়ছে। শান্ত-স্বস্তি-স্থিতি সব যেন চিরতরে হারিয়ে যেতে বসেছে। সবাই কেমন মারমুখী, আক্রমণাত্মক। ভাই বলেও রেহাই মিলছে না; শালা বলে তেড়ে আসছে। প্রত্যেকে যেন প্রত্যেকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কেউ কারও বন্ধু নয়; সবাই সবার শত্রু, পথের কাঁটা। সবচাইতে বড় শত্রুতা ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে। পরস্পরকে দেখে নেওয়ার, শিক্ষা দেওয়ার বিরামহীন প্রতিযোগিতা চলছে তো চলছেই।
গত কয়েকদিন ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে কথার যুদ্ধ চলছে। এ ভেসে যাবে, ও তলিয়ে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে, বিলুপ্ত হয়ে যাবে–এমন কথা একে অন্যের বিরুদ্ধে নেতানেত্রীরা বিরামহীন বলে যাচ্ছেন। নির্বাচনের বছরে অবশ্য এ ধরনের কথার লড়াই চলাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এরপরও অস্বস্তি কাটছে না। বিগত জাতীয় নির্বাচনের দুঃসহ সহিংসতার স্মৃতি সবাইকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আবার কখন কোন অজুহাতে শুরু হয়ে যায় মহাতাণ্ডব, এই ভয়ে সবাই দমবন্ধ প্রতীক্ষায় আছে!


বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের নীতি হচ্ছে, ‘যে আমার সঙ্গে নেই, সে আমার বিরুদ্ধে।’ ওদিকে বিরোধী পক্ষ সরকারকে জব্দ করতে সব রকম চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে উদ্বেগ বাড়ছে সাধারণ মানুষের মনে। কৈশোরে এক রাজনৈতিক নেতার বক্তৃতা শুনেছিলাম। তিনি মাইকে চিৎকার করে বলছেন, ‘ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আজ আপনাদের প্রতি আহ্বান, আপনারা গর্জে উঠুন, দুঃশাসনকে বাংলার মাটিতে চিরতরে কবর দিন।’ ইতিহাসের সেই ক্রান্তিকাল চলছে তো চলছেই। প্রায় চার দশক ধরে একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বড় দীর্ঘ এই ইতিহাসের ক্রান্তিকাল। যেন এর শুরু আছে, শেষ নেই। ক্রান্তিকাল ক্রমেই আরও দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। মাঠ-ময়দান থেকে দূরাগত মাইকে, জননেতাদের বক্তৃতায়, বিবৃতিতে, সংবাদপত্রের ক্ষুরধার রাজনৈতিক কলামে, অফিস-আদালতে, আড্ডায়, নাটকে-সাহিত্যে, এখনও ‘ইতিহাসের ক্রান্তিকালে’র বিরামহীন উচ্চারণ অব্যাহত আছে। পৃথিবীতে কত কী অদল-বদল হয়েছে, শুধু সেই বুলি–‘ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে...’ অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। যেন সচীন সেনগুপ্তের সিরাজ-উদ-দৌলার ভাঙা রেকর্ড বাজছে–‘বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা।’ বাংলার এই ‘ভাগ্যাকাশ’ যে কবে নাগাদ দুর্যোগমুক্ত হবে আর কবে আমরা স্নিগ্ধ শ্যামল আকাশ দেখতে পাবো, সেটা একটা জটিল ধাঁধা। মোশতাক-জিয়া-সাত্তার-এরশাদ-খালেদা-হাসিনা-খালেদা-হাসিনা–গত চার দশকে ক্ষমতায় কতজন এলেন-গেলেন; কিন্তু ইতিহাসের ‘ক্রান্তিকাল’ কিংবা ‘ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা’ আমরা কারও হাত ধরেই উৎরাতে পারিনি। প্রত্যেক শাসনামলই ছিল ‘খারাপ সময়’। এক খারাপ সময় অতিক্রম করে আরেক ‘খারাপ সময়ে’ পৌঁছেছি; কিন্তু সুসময় বা সুদিনের দেখা পাইনি।
ছোটবেলায় বাড়িতে আড্ডা বসতো, প্রতিবেশী প্রবীণরাও সে আড্ডায় অংশ নিতেন। স্থানীয় রাজনীতি, হানাহানি, কাটাকাটি, চুরি-ডাকাতি, পারিবারিক সংকট, দাম্পত্য কলহ, প্রেম-বিয়ে, বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি, খেলাধুলা–ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এলোপাতাড়ি আলোচনা হতো। এসব আলাপ-আলোচনার শেষ কথা বা সারমর্ম ছিল–আসলে সবকিছু দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ঘোর কলিকাল শুরু হয়েছে। দিনকাল খুবই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সাবধান, খুব সাবধান! মজার ব্যাপার হচ্ছে, যাদের মুখে এ ধরনের সাবধানবাণী বেশি শোনা যেতো, তারাই বিপদগ্রস্ত হতেন বেশি!
আমাদের দেশের গণমানুষ কিন্তু এখনও যথেষ্ট সাবধানী। অনেক হিসাব-নিকাশ করেই গণমাধ্যমের লোকজন পথ চলেন, সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এত সাবধানী হয়েও তাদের কোনও লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না। যখন যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তখন তারাই অসংযমী ও বেপরোয়া হয়েছেন। ফল সেই একই–সাধারণ মানুষের সর্বনাশ। সর্বনাশ হতে হতে এর মাত্রাটা বেড়ে ‘সাড়ে সর্বনাশে’ গিয়ে পৌঁছেছে। সাবধানের মার নেই–কথাটা অচল হয়ে গেছে। শত সাবধানতা সত্ত্বেও মার খেতে হচ্ছে। আর তা হবে না-ই বা কেন? যারা আক্রমণকারী, উদ্ধত, সেই সন্ত্রাসীরা তো আর সাবধানী হচ্ছে না। তাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড থামানোর কোনও আয়োজন নেই। সরকার সন্ত্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না। ফলে এসব অপশক্তি নির্বিঘ্নে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ ও নিরীহরা সাবধানী হয়েও মার খাচ্ছেন, বিপদগ্রস্ত হচ্ছেন। ফলে দিনকাল আরও খারাপ হচ্ছে; ‘ক্রান্তিকাল’কিছুতেই কাটছে না।

জাতি হিসেবে আমরা বাঙালিরা বড়ই বিচিত্র স্বভাবের। আমরা ঝগড়া করি, কলহ করি, খুনোখুনি মারামারি সবকিছুই করি নিজেদের মধ্যে। ভিনদেশ, ভিন জাতির প্রতিও আমাদের বৈরিতা আছে, তবে স্বজাতির প্রতিই আমাদের ক্ষোভ-বৈরিতা বেশি! আমাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আমরা খুব সহজে ও তুচ্ছ কারণে ঝগড়া-ফ্যাসাদে জড়িয়ে যাই; কিন্তু পরে আর এই ঝগড়া নিজেরা মেটাতে পারি না। এজন্য তৃতীয় পক্ষের দরকার হয়। এই তৃতীয় পক্ষ বিদেশি হলেও আমাদের কোনও আপত্তি থাকে না। এদেশে বিয়ে করতেও তৃতীয় পক্ষ বা ঘটক লাগে। সামান্য একটি গরু কিনতে গেলেও তৃতীয় পক্ষ দালালের সাহায্য নিতে হয়। এই ‘তৃতীয় পক্ষ’কালচারের কারণেই এদেশে শুধু একটা নির্বাচন করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান চালু করতে হয়েছিল। বিদেশিদের প্রতি আমাদের মাত্রাতিরিক্ত পক্ষপাত লক্ষ করা যায়। দেশি রেফারির তুলনায় তাই এখানে বিদেশি রেফারিরা মর্যাদা পায় বেশি। তাদের মান যেমনই হোক। ঢাকার ফুটবল ও ক্রিকেট লিগে নিম্নমানের বিদেশি খেলোয়াড়ের আধিক্য আমাদের বিদেশিদের প্রতি মোহেরই স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। দেশের ‘ঠাকুর’ ছেড়ে বিদেশের ‘কুকুর’ ধরতে আমরা বরাবরই অতি-উৎসাহী। তাই তো আমাদের দেশের রাজনীতিতে এখনও বিদেশিদের, বিদেশি রাষ্ট্রের প্রভাব লক্ষ করা যায়। আমরা সরকারের খারাপ কাজের সমালোচনা করলে কেউ তা পাত্তা দেয় না। বিরোধীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রবল গালমন্দ করলেও তারা গায়ে মাখে না। কিন্তু বিদেশিরা সেই সমালোচনা করলে সবার মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। এটা সম্ভবত আমাদের জাতেরই দোষ।
ইতিহাস ঘাঁটলেও দেখা যায়, বাঙালি বার বার বহিরাগতদের বশ্যতা মেনে নিয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভিনদেশিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছে; কিন্তু নিজেদের মধ্যে কে প্রভু হবে–এ নিয়ে মরণপণ লড়াই করেছে। স্বজাতিপ্রীতি অপেক্ষা বাঙালির বিদেশিপ্রীতি সবসময় বেশি বলে মনে হয়েছে। শত্রুকে উচ্ছেদ করতেও বাঙালি বার বার বাইরের লোক ডেকে এনেছে।
আসলে বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন সংস্কৃতি, বিভিন্ন সভ্যতার সংঘাত-প্রতিঘাতে বাঙালির চরিত্রে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য বাসা বেঁধেছে। কারও সঙ্গে কারও মিল নেই, একতা নেই। তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাঙালি হুজুগে মাতে বটে। এই হুজুগে অনেক কিছুই ওলট-পালট হয়ে যায়। বৈদিক ধর্মকে বাঙালি পুরোপুরি গ্রহণ করেনি; কিন্তু বেদ-উপনিষদের ঋষিরা বাঙালির কাছে আজও নমস্য। বৌদ্ধ ধর্ম বাংলায় টিকলো না, কিন্তু বুদ্ধদেব বাংলার অবতারদের একজন। চৈতন্য দেবের শিষ্যরা বাঙালির কাছে অনেক ক্ষেত্রে উপহাসিত; কিন্তু নবদ্বীপের নিমাই বাঙালির অন্তরের ধন। ইসলাম ধর্মের মূল আদর্শ সাম্য-শান্তি ভ্রাতৃত্বকে বাঙালি আত্মস্থ করতে না পারলেও ইসলাম বাঙালির কাছে জনপ্রিয় হয়েছে। রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্ম বাংলাদেশের জনসাধারণ গ্রহণ করেনি; কিন্তু শিক্ষিত বাঙালির হৃদয়ে রামমোহন অত্যন্ত শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত। বিদ্যাসাগরের সারা জীবনের সাধনাবিধবা বিবাহ প্রচলন বাংলাদেশে অপ্রচলিত; কিন্তু বিদ্যাসাগরের নামে ঠিকই বাঙালির বুক গর্বে ভরে ওঠে। রবীন্দ্র সৃষ্টির সঙ্গে বাঙালির যোগ যতটুকু থাকুক তবু সে বাঙালির প্রাণের ঠাকুর। নজরুলকে না জেনে-বুঝেও বাঙালি তাকে মাথায় ঠাঁই দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে যে বাঙালি হাসিমুখে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, সেই বাঙালিই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সময় নীরব থেকেছে। সেনাশাসন ও সেনাশাসকের বিরুদ্ধে বাঙালি সবসময় উচ্চকিত হওয়া সত্ত্বেও মেজর জিয়া অনেক বাঙালির কাছে শ্রদ্ধাভাজন। বাঙালির চরিত্র এমন বৈপরীত্য দিয়েই গড়া। এমন দেশ সত্যিই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা খুঁজে পাওয়া যাবে না!

লেখক: কলামিস্ট