হকাররা হঠাৎ কেন জরুরি হয়ে উঠলেন?

রেজানুর রহমানফুটপাত আসলে কার? পথচারীদের জন্য? নাকি হকারদের জন্য? ফুটপাত বলতে আমরা বুঝি পথচারীদের জন্য হাঁটাপথ। মূল রাস্তায় গাড়ি চলে। কাজেই মূল রাস্তায় পথচারীদের চলাচলের সুযোগ নাই। তাই পথচারীদের সুবিধার্থে রাস্তার উভয়পাশে সরু পথের ব্যবস্থা করা হয়। এটাকেই আমরা বলি ফুটপাত। কাজেই ফুটপাতে পথচারীই থাকবেন, পথচারীরাই হাঁটবেন, এ ব্যাপারে তো কারও কোনও দ্বিমত থাকার কথা নয়। অথচ দ্বিমত উঠেছে। খোদ সরকারি দলের একজন আলোচিত নেতা এ ব্যাপারে দ্বিমত সৃষ্টি করেছেন এবং নিজ দলেরই অন্য এক জনপ্রিয় নেতার সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছেন। দুই নেতার বিরোধপূর্ণ দ্বন্দ্বে নারায়ণগঞ্জবাসীর এখন নাকাল অবস্থা।
দুই নেতার একজন বলছেন, ফুটপাতে হকার থাকবে না। অন্যজন এর চরম বিরোধিতা করে বলছেন, ফুটপাত হকার থাকবে। হকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ না দিয়ে ফুটপাত থেকে সরানো যাবে না। এই নিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরে যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেলো তা দেখে মনে প্রশ্ন জাগছে হঠাৎ হকাররাই বা কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রদায় হয়ে উঠলেন? এর পেছনে আদৌ কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে?

একটি পুরনো ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ি। দৈনিক ইত্তেফাকে বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে সবেমাত্র যোগ দিয়েছি। স্যার এফ রহমান হলের ছাত্র ছিলাম। পাশেই নীলক্ষেত মোড়ে ফুটপাতে বসা পত্রিকা বিক্রির দোকানে প্রায় প্রতিদিনই ঢুঁ মারতাম। শামীম নামে একজন হকারের সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে উঠলো। ইত্তেফাকে সাংবাদিকতা শুরু করেছি বলেই হয়তো সে আমাকে অধিকহারে পাত্তা দিতো। তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে প্রায় প্রতিদিনই ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রায় সব দৈনিকের হেড লাইন দেখে নিতাম।

হঠাৎ একদিন দেখি নীলক্ষেত এলাকার ফুটপাতে কোনও দোকান-পসরা নাই। দুই একজন হকার তাদের জিনিসপত্র বস্তায় ভরে রেখে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছে। ঘটনা ক? শামীমকে খুঁজলাম। সে নেই। কিছুক্ষণপর দেখি শামীম খোশ মেজাজে হেঁটে আসছে। তাকে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই বলল– এলাকার থানায় নতুন পুলিশ অফিসার আসছেন...। তার নির্দেশে এলাকার ফুটপাতে সকল হকারকে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। শামীমকে জিজ্ঞেস করলাম– তার মানে এখন থেকে ফুটপাতে আর কোনও দোকান-পসরা থাকবে না? হকাররা বসবেন না? উত্তরে শামীম মৃদু হেসে বলল– চিন্তার কিছু নাই। আরে ভাই, হ্যারা পুরা ঢাকা শহরের হকারদের কাছ থাইক্যা প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে। আমাদেরকে বসতে না দিলে এই টাকা তো পাবে না। কাজেই চিন্তার কিচ্ছু নাই... আমাদের নেতারা পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে বসেছেন। আজই একটা ফয়সালা হয়ে যাবে।

ফয়সালাটা কেমন? শামীমকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, ফয়সালা মানে বুঝলেন না? আমরা দৈনিক যে চাঁদা দেই সেটা নিয়াই দেন দরবার শুরু হয়েছে। চাঁদার পরিমাণ হয়তো বাড়বে।

শামীমকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা প্রতিদিন যে চাঁদা দেন সেটা কি থানার পুলিশ একাই খায়...?

শামীম হেসে বলল, আরে না পুলিশ একা খাইবো কী কইর‌্যা। চাঁদার টাকা বারো ভূতে খায়। বুঝলেন না? এলাকার ছাত্র নেতা, যুবনেতা, প্রভাবশালী মাস্তান তো আছেই। প্রশাসনের ওপরের দিকের অনেক কর্মকর্তাও চাঁদার ভাগ পায়... কাজেই চিন্তার কিছু নাই... সন্ধ্যায় আইস্যা দেখবেন আমরা নিশ্চিন্তে দোকানদারি করতেছি।

কৌতুহলবশত সন্ধ্যায় নীলক্ষেত মোড়ে গিয়ে দেখি সবকিছুই আগের মতো চলছে। দেখে বোঝার উপায়ই নাই সকালে পুলিশ এলাকার হকারদের তুলে দিয়েছিল।

নীলক্ষেতসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাত থেকে হঠাৎ হকার উচ্ছেদ আবার হঠাৎ ফুটপাতে বসে যাওয়ার দৃশ্য এই জীবনে বহুবার দেখেছি। একবার মতিঝিল এলাকার রাস্তায় ফুটপাত থেকে হঠাৎই হকারদের উচ্ছেদ করা হলো। পুলিশের সঙ্গে হকাররা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লো। ওমা! পরের দিনই দেখি পরিস্থিতি শান্ত। হকাররা আরও বেশি অধিকার নিয়ে ফুটপাতে দোকান-পসরা বসিয়েছেন। ফুটপাতের ওপর পথচারীদের থেকে তাদের অধিকারই যেন বেশি।

প্রশ্ন উঠতেই পারে তাদের এই অধিকার দেখানোর সাহস দেয় কে? ‘এখানে হকার বসা নিষেধ’– এমন সাইনবোর্ডের পাশেই হকাররা বসেন কোন সাহসে? উত্তরটা বোধকরি নারায়ণগঞ্জের ঘটনা থেকেই পাওয়া যাবে।

বিনীত ভাবে একটা কথা বলি। হকাররাও মানুষ। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে তারা এই পেশা বেছে নিয়েছে। সংবেদনশীল মানুষ মাত্রই উচিৎ তাদের পাশে দাঁড়ানো। আর তাই হঠাৎ করে হকারদের উচ্ছেদ করা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। নারায়ণগঞ্জের ক্ষেত্রে যতটুকু জানি হকারদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাদের জন্য আলাদা মার্কেট তৈরি করেই ফুটপাত থেকে ওঠে যেতে বলা হয়েছে। তারপরও হকারদের পক্ষ নিয়ে নারায়ণগঞ্জে কেন অরাজকতার সৃষ্টি করা হলো এটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন!

প্রচার মাধ্যম মারফৎ জানতে পারলাম নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় সরকার বিব্রত হয়েছেন। ঘটনা তদন্তের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। হয়তো অচিরেই ঘটনার একটা সুষ্ঠু সমাধান হবে। নারায়ণগঞ্জের বিবাদমান দুই নেতাও হয়তো হাতে হাত মিলিয়ে নতুন করে খবরের শিরোনাম হবেন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে হকারদের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে সৃষ্টি অপ্রীতিকর ঘটনায় সারাদেশে যে নেতিবাচক বার্তাটি ছড়িয়ে গেলো তার দায়-দায়িত্ব কে নেবে?

বর্তমান সরকার দেশের উন্নয়নে প্রশংসনীয় একাধিক কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছে। সময়টাই অচলায়তন ভাঙার। ঢাকার (উত্তর) প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ঢাকার তেজগাঁও-এ ট্রাক স্ট্যান্ড সরিয়ে একটা সুন্দর রাস্তা তৈরি করেছেন। এই কাজেও তাকে বাধা দেওয়া হয়েছিল। এখন এই এলাকা দিয়ে যাতায়াত করার সময় সবাই স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেন। এখান থেকে ট্রাক স্ট্যান্ড সরেছে এবং বিকল্প জায়গাও করে নিয়েছে। কাজেই শর্ত জুড়ে দিয়ে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বাধার সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। সরকারে থেকে সরকারি দলেরই কেউ এটা করলে সেটা হবে বড় ভুল।

লেখক: সম্পাদক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার।