মন্ত্রিসভা নতুন যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনুমোদন দিয়েছে, এর একাধিক ধারা নিয়ে অনেক আলোচনা ও প্রশ্ন আছে। কিন্তু সেই আলোচনায় না গিয়ে আমি শুধু ৩২ধারায় সীমাবদ্ধ থাকতে চাই। সেই ৩২ ধারায় বলা হয়েছে–‘যদি কোনও ব্যক্তি বে-আইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনও সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোনও সংস্থার কোনও ধরনের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত, কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ।’
আর এই অপরাধের শাস্তি হতে পারে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং ২৫ লাখ টাকা জরিমানা।
সাধারণভাবে যেকোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত ও গোপন তথ্য সংরক্ষণের অধিকার আছে। আর তা আইনগতভাবেই সংরক্ষিত। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট রাষ্ট্রের গোপন তথ্য সংরক্ষণ করে। আর গুপ্তচরবৃত্তির বিরুদ্ধেও আলাদা আইন আছে। তাহলে এই আইনটি কেন করা হলো, তা আলোচনার আগে এই আইনটির মাধ্যমে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং কিভাবে হবেন তা তুলে ধরছি।
সাংবাদিকতায় অনুসন্ধান একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। আর এই অনুসন্ধান শব্দটির মধ্যেই গোপন শব্দটি রয়েছে। যা প্রকাশ্যে আছে বা চাইলেই যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তা অনুসন্ধান করতে হয় না। কেউ যদি ঘুষ খান বা দুর্নীতি করেন, তাহলে তা গোপনেই করেন। আর তা যদি প্রকাশ করতে হয়, তা যদি জানতে হয়, তাহলে তা গোপনে ও কৌশলেই করতে হয়। এখন এই ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি আইনের ফলে যা হবে–
১. সরকার, আধা সরকারি, ,স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোনও সংস্থায় গিয়ে সাংবাদিকরা ঘুষ-দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে পারবেন না।
২. ঘুষ-দুর্নীতির কোনও দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারবেন না।
৩. এসব অবৈধ কাজের কোনও ভিডিও বা অডিও করতে পারবেন না।
৪. কোনও ডকুমেন্ট, ভিডিও, অডিও সংগ্রহ বা ধারণ করলেও তা প্রকাশ করতে পারবেন না।
এটা শুধু কি সাংবাদিকদের সমস্যা। না, তা নয়। সাধারণ নাগরিকরা সেবা নিতে গিয়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে নানা ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হন। তারা ঘুষ দিতে বাধ্য হন। টিআইবি’র জরিপে বলা হয়েছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষকে ঘুষ দিতে হয়। আর ২০১৫ সালে এই সেবা নিতে গিয়ে মানুষকে ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এখন কেউ যদি এই ঘুষের ডকুমেন্ট, ভিডিও বা অডিও ধারণ করেন, তাহলে তা প্রকাশ করতে পারবেন না। ঘুষ দেবেন এবং তার প্রমাণ থাকলেও প্রকাশ করতে পারবেন না। কারণ তিনি তো অনুমতি নিয়ে ওই ডকুমেন্ট ধারণ করেননি। প্রকাশ করলে তিনি বা যিনি ভিডিও করেছেন গোপনে, তা ধরা পড়লে তাদের ১৪ বছরের জেল।
নতুন ডিজিটাল আইনের ৩২ ধারাকে কেউ কেউ তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার চেয়েও ভয়ঙ্কর বলছেন। নিরীহ না ভয়ঙ্কর তা এই আইন কাদের সুরক্ষা দেবে, তা একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এরইমধ্যে বলেছেন, ‘আপনারা (সাংবাদিকরা) গণমাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেন, তাতে তাদের মান-ইজ্জত থাকে না। তাদের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়। তারা তো জনপ্রতিনিধি। তাই এগুলো ঠেকাতেই এ আইন করা হয়েছে।’
এই আইনে আসলে মোটা দাগে দুর্নীতিবাজ ও ঘুষখোরদের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে সরকারের কী লাভ? এর জবাব সরকারই ভালো দিতে পারে। তবে নির্বাচনের ঠিক একবছর আগে যারা সরকারকে এই ধরনের এই আইন করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা না ভেবে দেননি। সেই ভাবনার কিছু হয়তো আমি অনুমান করতে পারি।
১. নির্বাচনের আগে মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতি, অনাচার, অন্যায় যেন সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ করতে না পারে।
২.পুলিশ ও প্রশাসনের দুর্নীতি, অনাচার, অন্যায় যেন সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ করতে না পারে।
৩. প্রশাসন, পুলিশ ও জন-প্রতিনিধিদের চিন্তামুক্ত রাখা–যেন তারা নতুন কোনও অন্যায় করলেও তা সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ করতে না পারে।
মন্ত্রিসভা ডিজিটাল আইন অনুমোদন দেওয়ার পর এখন আইন আইনমন্ত্রী বলছেন–সত্য প্রকাশ গুপ্তচরবৃত্তি হবে না। সাংবাদিকরা যদি কোনও অবৈধ ঘটনা প্রকাশ করেন, তাহলে গুপ্তচরবৃত্তি হবে না। কিন্তু তিনি ৩২ ধারা বাতিলের কথা বলছেন না। প্রকাশ তো অনেক পরের কথা, এই আইনে শুধু প্রকাশ নয়, ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ অপরাধ হিসেবে গণ্য। প্রকাশ না করলেও অপরাধ হবে।
ছোট একটি উদাহরণ দিয়ে বলছি। যদি কেউ গোপনে দুর্নীতির ভিডিও ধারণ করেন আর তা যদি কোনোভাবে দুর্নীতিবাজ জানতে পারেন, তাহলে ভিডিও ধারণকারীর শাস্তি হবে (ধারণ)। তিনি যদি ওই ভিডিও প্রকাশ না করে নিজের কাছে রাখেন তাহলেও শাস্তি (সংরক্ষণ)। তিনি যদি ফেসবুকে পোস্ট না দিয়ে কাউকে ইনবক্স করেন বা মেইলে পাঠান (প্রেরণ); তাহলেও শাস্তি পেতে হবে। আর প্রকাশ করলে তো কথাই নেই। আইনে সহায়তাকারীর একই শাস্তি। তার মানে হলো কোনও সরকারি দফতরের সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতির কোনও ডকুমেন্ট, ভিডিও বা অডিও ধারণ বা প্রকাশে সহায়তা করেন, তারও শাস্তি হবে।
আর বে-আইনি প্রবেশের মাধ্যমে শব্দটি আরও ভয়াবহ। এখন সব প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের আগাম অনুমতি লাগবে। যদি সেই অনুমতি লিখতে না হয়, তাহলে তা অস্বীকার করেই সাংবাদিক বা যেকোনও সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেওয়া যাবে। আসলে এই আইনটি করাই হয়েছে সাংবাদিকদের ‘প্রতিহত’করতে। যারা করেছেন তারা বাংলাদেশে ‘নিরীহ’সাংবাদিকতার নতুন অধ্যায় শুরু করতে চান। যে সাংবাদিকের চোখ নাই, দাঁত নাই, শিং নাই, করে না ফোসফাঁস–এমন সাংবাদিকই তারা চান। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের সাংবাদিকতা তারা চান না। তারা চান না স্বচ্ছতা ও সুশাসন।
গুপ্তচরবৃত্তি রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ। রাষ্ট্র ও সরকার এক নয়। রাষ্ট্রের গোপন তথ্য আর সরকারের গোপন তথ্যও এক নয়। আর সরকার সব সময়ই চায় এই রাষ্ট্রের স্বার্থের কথা বলে সরকারের স্বার্থ রক্ষা করতে। অনেক কিছু গোপন করতে। আর ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির নামে নতুন যে আইন মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিল তার মাধ্যমে সরকার ঘুষ, দুর্নীতি ও অনাচারকেও রাষ্ট্রের স্বার্থে গোপন তথ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিলো বলেই মনে হয়।
আরেকটি কথা বলি। ডিজিটাল বাংলাদেশের এই ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির আইন বাংলাদেশকে অ্যানালগে নিয়ে যেতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক
ইমেইল: swapansg@yahoo.com