কিন্তু নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল খেলায় ভারতীয় ক্রিকেট দল এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে বাংলাদেশকে অবজ্ঞা করার দিন শেষ। বরং বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে এখন থেকে সমীহ করতে শিখতে হবে। নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে বাংলাদেশের কাছে ভারত ক্রিকেট দল তো হারতেই বসেছিল। শেষে না ভারতের জয় হয়েছে। কিন্তু সেটা হয়েছে ভাগ্যের জোরে। অন্তত নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল খেলায় যোগ্যতার মাপকাঠিতে জয় পায়নি ভারত। ভাগ্যদেবী ভারতের প্রতি হয়তো বেশি প্রসন্ন ছিল। কিন্তু সেদিনের ক্রিকেট লড়াইয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখতেই হবে। বাংলাদেশ লড়াই করে হেরেছে। এতে লজ্জার কিছু নেই। বরং এক অর্থে বিজয়েরই আনন্দ আছে। নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল শুরুর আগের দিন ভারতীয় দলের হয়ে একজন তরুণ খেলোয়াড় বাংলাদেশকে নিয়ে যে ধরনের অবজ্ঞার প্রকাশ ভঙ্গি দেখিয়েছিলেন, ফাইনালের দুর্দান্ত লড়াই শেষে জানি না এখন তার মনোভঙ্গি কী? তিনি কি এখনও ভাবছেন বাংলাদেশের সঙ্গে ফাইনালে জিতলে কোনও কৃতিত্ব নাই? আমার ধারণা, নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল খেলার পর বাংলাদেশ দল সম্পর্কে শুধু তার নয়, তার গোটা দলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন নিশ্চয়ই হয়েছে।
আসলে যোগ্যতা না থাকলে কেউ কাউকে মূল্য দেয় না। পরিবারের কথাই ধরুন না। তিন সন্তানের দু’জন ভালো চাকরি করে। বাবা-মা হয়তো তাদেরকেই বেশি গুরুত্ব দেন। যার চাকরি নাই,বেকার, তার প্রতি হয়তো বাবা-মায়ের টান আছে। কিন্তু অন্য দুই ছেলের মতো নয়। বেকার ছেলেটির কি করা উচিত? নিজেকে যোগ্য করে তোলা উচিত। তখন হয়তো শুধু বাবা-মা নয়, ভাইয়েরাও তাকে সমীহ করে কথা বলবে।
ক্ষুদ্র পরিসরে যখন এই মনোভঙ্গি তখন ক্রিকেটের মতো আন্তর্জাতিক পরিসরে যোগ্যতার গুরুত্ব কতখানি তা সহজে অনুমেয়। আমরা কি সাহসের সঙ্গে বলতে পারি ভারতের সঙ্গে আমাদের ক্রিকেট লড়াইয়ে জয়ের চিত্রটা বেশ উজ্জ্বল? নিশ্চয়ই না। বরং পরাজয়ের চিত্রটাই উজ্জ্বল। পরাজিতদের সঙ্গে কেউ থাকতে চায় না। তাদেরকে সমীহও করে না। শ্রীলঙ্কার নিদাহাস ট্রফি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সামনে অমিত সম্ভাবনা আর সাহসের দ্বার খুলে দিয়েছে। এখন প্রয়োজন এই সম্ভাবনাকে সঠিক পরিকল্পনার মোড়কে যুক্ত করে এগিয়ে যাওয়া।
আমাদের ধারণা, শ্রীলঙ্কার নিদাহাস ট্রফিকে ঘিরে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনায় বাংলাদেশের ক্রিকেটের শত্রু-মিত্রের চেহারা ফুটে উঠেছে। নিদাহাস ট্রফির সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের খেলা চলাকালে সৃষ্ট অপ্রীতিকর ঘটনার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আন্তর্জাতিকখ্যাত কয়েকজন ক্রিকেট সমালোচক বাংলাদেশেরই সমালোচনা করেছেন। তাদের অনেকের কথায় মনে হয়েছে, খেলার মাঠে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা বাংলাদেশের উচিত হয়নি। অথচ যারা এ ধরনের কথা বলেছেন তাদেরই কেউ কেউ অতীতে ক্রিকেট মাঠে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে মাঠ থেকে বেরিয়েও এসেছেন। পাশের দেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের ‘বেত্তমিজ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত দুই বক্তার একজন আমাদের সাকিব আল হাসানের নামও ভুল উচ্চারণ করেছে। এর অর্থ কী? এর অর্থ হলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে অবজ্ঞা করা অথবা গুরুত্ব না দেওয়া। ওরা নিশ্চয়ই অস্ট্রেলিয়া, সাউথ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারদের নাম উচ্চারণ করার সময় ভুল বলে না। কেন বলে না? বলে না এই জন্য যে ওই সব দেশ ক্রিকেটের পরাশক্তি।
ক্লাসে ভালো ছাত্রছাত্রী হতে হয়। তা না হলে শিক্ষক-শিক্ষিকা তো দূরের কথা, সহপাঠীরাও গুরুত্ব দেয় না। একথার একটাই অর্থ– বাংলাদেশ ক্রিকেটে দলের সকল সদস্যকে ভালো শিক্ষার্থী হতে হবে। কিন্তু তাদেরকে শিখাবে কে? হাথুরে সিং চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের হেড কোচের পদে বারবার জোড়াতালি দেওয়া হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় এই যে এত বড় একটা সাফল্য দেখালো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল, তা ধরে রাখার ক্ষেত্রে আছে কি সঠিক কোনও পরিকল্পনা? খেলার মাঠে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে জিতে যাওয়ার টেকনিক জানাটাও জরুরি। ভারত-বাংলাদেশের খেলায় এক ওভারে ২২ রান দিয়েছে আমাদের রুবেল। মূলত মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে সে পর্যুদস্ত হয়েছে। শেষ ওভারে এক বলে ৫ রান দরকার ভারতের। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বোলারের উচিত এমন ভাবে বল করা, যাতে ব্যাটসম্যান ছক্কা বা চারের মার মারতে না পারে। কিন্তু আমাদের সৌম্য মনস্তাত্ত্বিক এই লড়াইয়ে টিকতে পারেনি। ক্রিকেট মাঠের এমন পরিস্থিতিতে খেলোয়াড়দের কি করা উচিত তা নিয়েও বিস্তর চিন্তাভাবনা দরকার। ক্রিকেট বোর্ড নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে ভাবছেন।
এবার একটা সুখের কথা বলি। নিদাহাস ট্রফির সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ফাইনালে উঠে যাওয়ার পর উপমহাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ভূয়সী প্রশংসা করে এক টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার ম্যাচটা কী দুর্দান্তই না হলো। বাংলার অদম্য এক জয় দেখলাম’। ভারতের সঙ্গে ফাইনালে পুরো জয়টা দেখার জন্যই ১৮ মার্চ সন্ধ্যার পর থেকে গোটা দেশ জেগেছিল। বাসাবাড়িতে তো বটেই, হোটেল,রেস্তোরাঁ,রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানসহ বিভিন্ন জায়গায় সবার চোখ ছিল টেলিভিশনের পর্দায়। আহ! কী মায়া জড়ানো এক একটা মুখ। এই বুঝি বাংলাদেশ জিতে গেলো-এমন রুদ্ধশ্বাসপূর্ণ অপেক্ষা ছিল সারাদেশে! বাংলাদেশ জিতেনি। কিন্তু বাংলাদেশ হারেওনি! আমরা ক্রিকেটে এমন হেরে যাওয়া বাংলাদেশকেই দেখতে চাই। এভাবেই হারলেই একদিন জয় আসবে। জয় হোক বাংলাদেশের ক্রিকেটের।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।