ট্রাম্পের পাগলামি

আনিস আলমগীরএকের পর এক উদ্ভট খবর তৈরি করেই যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কখনও নিজের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে টুইট করে বিদায় দিচ্ছেন। কখনও অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে মুখ না খোলার জন্য কোনও মহিলার সঙ্গে চুক্তি করছেন। আবার এমন চুক্তি ফাঁস করার জন্য উল্টো পর্নো তারকার কাছে টাকা দাবি করছেন তিনি।
গত সপ্তাহে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি আদালত ট্রাম্পের সঙ্গে নির্বাচনের আগে স্বাক্ষরিত একটি অপ্রকাশ চুক্তির ভিত্তিতে পর্নো তারকা বা প্রাপ্তবয়স্কদের ছবির অভিনেত্রী স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে মুখ না খুলতে নির্দেশ দিয়েছিল। চুক্তিমতো যতবার তিনি মুখ খুলবেন,ততবার নাকি তাকে এক মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ট্রাম্পের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়ে চুপ থাকার জন্য ড্যানিয়েলসকে ট্রাম্প ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার দিয়েছিলেন। ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী মাইকেল কোহেন এই চুক্তি দেখিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার জন্য স্টর্মির কাছে ২০ মিলিয়ন ডলার চেয়ে বসেছেন।
মার্কিন টিভির প্রাইম টাইম শোগুলোর সিংহভাগজুড়ে থাকে ট্রাম্পের এমন সব কাণ্ড নিয়ে হাসি ঠাট্টা। তার উদ্ভট সিদ্ধান্তের কৌতুকপূর্ণ কড়া সমালোচনা। অবশ্য ট্রাম্পকে নিয়ে যেসব সমালোচনা, হাসি ঠাট্টা হয় সেটা অন্য কোনও দেশের মিডিয়ায় সম্ভব কিনা সেটা আমাকে ভাবায়। এটাও দেখার বিষয়,তার আগে কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে মিডিয়া এমন সমালোচনা করেছে কিনা। এমন উদ্ভট প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগে দেখেনি,যার কারণে ডুবতে বসেছে আমেরিকা, আর ভেঙে যেতে বসেছে বিশ্বব্যবস্থা।

১৯৯০ সালে সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা বিশ্বের একক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। মূলত বিশ্বের নেতৃত্ব কর্তৃত্ব তারই হাতে ছিল। বিশ্বের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব যে রাষ্ট্রের হাতে থাকে সে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে খুবই উত্তম কৌশলী ব্যক্তি হতে হয়। আমেরিকার গত ৪৫ জন প্রেসিডেন্টের মধ্যে আমরা ৪৩ জনকেই যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে পেয়েছি। ট্রাম্পের আগে জুনিয়র বুশ অর্থাৎ জর্জ ডব্লিউ বুশও ছিলেন কম মেধার মানুষ। তিনি দুনিয়াটাকে বহু ওলট-পালট করতে চেয়েছেন। অনেক কিছু করেছেনও।

সবকিছু একতরফা চলে না। যখন ১১ সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ারের ঘটনা ঘটলো তখন আমেরিকা অনুভব করলো তাদের পৃথিবীটা উল্টে গেছে। সেদিন বুশ প্লেনে আড়াই ঘণ্টা আকাশে ছিলেন। সে থেকে বিশ্বে বিভিন্ন জায়গায় আমেরিকার দূতাবাস, স্থাপনা ইত্যাদি পাহারা দিতে আমেরিকার খরচ হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি ডলার। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও আমেরিকার খরচ হয়েছিল ৪৫ হাজার কোটি ডলার। দুই দুইটা মহাযুদ্ধে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে কোনও শক্তিই আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে একটা আঁচড় পর্যন্ত লাগাতে পারেনি। শেষাবধি আমেরিকার হৃদকম্প সৃষ্টি করলো আল কায়েদা, ওসামা বিন লাদেনের একটা সন্ত্রাসী বাহিনী।

এরপর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেন বারাক ওবামা। ২০০৮ সালে চূড়ান্ত আর্থিক মন্দার মধ্যে ওবামা প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। কোনও রকমে সামাল দিয়ে দুই দফা তিনি ৮ বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওবামা ছিলেন মেধাবী লোক। তার পরে আরও যোগ্য আরও মেধাবী লোকের প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কী ডেমোক্রেট কী রিপাবলিকান- উভয় দলে তেমন উপযুক্ত লোক আগ্রহ ভরে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য আসলেন না। শুধু ডেমোক্রেট দলের সিনেটর সেন্ডারর্স উপযুক্ত হলেও প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন এবং ওবামার কারণে তিনি নমিনেশন পেলেন না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো রিপাবলিকানের ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্রেটের হিলারি ক্লিনটনের মধ্যে। আমেরিকার ইতিহাসে কোনও নারীর প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ থাকলেও হিলারি হতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলেন।

শাসক হিসেবে ব্যবসায়ী লোক উপযুক্ত হয় না। এখন শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হচ্ছে তা-ই। ট্রাম্পের নেতৃত্বে আমেরিকার দিন দিন করুণ অবস্থা হচ্ছে। বিশ্বও তার ভারসাম্য হারানোর পথে। এই অবস্থায় বিশ্বের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। নিজেই আমেরিকার জন্য একটা কোণঠাসা অবস্থা সৃষ্টি করে ফেলেছেন।

ট্রাম্পের আমলে যত উপদেষ্টা হোয়াইট হাউসে আসা যাওয়া করছেন সে অবস্থা কখনও ছিল না। ক’দিন আগে ট্রাম্প তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনকে টুইট বার্তার মাধ্যমে বিদায় করে দিয়েছেন। তার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেননি। এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণাও দেননি। যেন কোনও মুনিব তার কাজের চাকর বিদায় দিলো। ট্রাম্পের সঙ্গে টিলারসনের মতের ভিন্নতা ছিল উত্তর কোরিয়া এবং ইরান নিয়ে। টিলারসন সবসময় শান্তিপূর্ণ আলোচনার পক্ষে ছিলেন।

এই মার্চ মাসে বিদায় নিয়েছেন তার শীর্ষ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা গ্যারি কন। ট্রাম্প স্টিল আমদানির ওপর কর আরোপ করেছেন। আর গ্যারি কনের অপরাধ হচ্ছে তিনি ট্রাম্পের এই কর আরোপকে সমর্থন করেননি। প্রধান পরামর্শক স্টিভ ব্যানন পদত্যাগ করেছেন গত বছরের ১৮ আগস্ট। ২২ জুলাই পদত্যাগ করেছেন প্রেস সেক্রেটারি শন স্পাইসার। স্বাস্থ্যমন্ত্রী টম প্রাইম ২০ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ৩১ জুলাই সরে যেতে হয় চিফ অব স্টাফ রেইন্স প্রিবাসকে। আর গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসের যোগাযোগ পরিচালক হোপ হিকস পদত্যাগ করেন। অবসরের যাওয়ার মাত্র একদিন আগে এফবিআইয়ের উপ-পরিচালক অ্যান্ড্রু ম্যাকক্যাব বরখাস্ত হন।

এখন শোনা যাচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল ম্যাক মাস্টারকেও তিনি সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাকে সরাতে সময়ক্ষেপণ করছেন যেন সরানোর বিষয়টা অসম্মানজনক না হয়। আর যাকে ম্যাক মাস্টারের পদে আনা হবে তাকেও যেন প্রস্তুতি নেয়ার সময় দেয়া হয়। ম্যাক মাস্টারের আগে মাইকেল ক্লিনকে নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের মিথ্যা তথ্য প্রদানের কারণে। হোয়াইট হাউসে সচিবদের আর উপদেষ্টাদের যাওয়া আসার এক স্রোত বইছে, যা এর আগে কখনও আমেরিকার জনগণ দেখেনি।

টিলারসনের স্থলে এখন ট্রাম্প নিয়োগ দিয়েছেন সিআইএ প্রধান মাইক পম্পিওকে। পম্পিও কঠিন প্রকৃতির লোক। ট্রাম্প আবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ছোট ছোট বোমা তৈরি করার। এটা ১৯৭০ সালে পরাশক্তিদের মধ্যে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তাররোধ চুক্তির (এনপিটি) বরখেলাপ। যেন আর কোনও পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার না ঘটে সে কারণে চুক্তিটি স্বাক্ষর করা হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সল্ট ২ চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে আমেরিকা এবং রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশ ও গরভাচেভ কৌশলগত অস্ত্র হ্রাস চুক্তি স্বাক্ষর করে।

১৯৯৩ সালে স্বাক্ষরিত হয় ট্রাস্ট ২ চুক্তি। এই চুক্তির ফলে আমেরিকা ও রাশিয়া পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস করে। ১৯৯৫ সালে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিকে (এনপিটি) ২৫ বছরের জন্য স্থায়ী রূপ দিতে জাতিসংঘে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এ পদক্ষেপগুলোর ফলাফল কি তা আমরা পর্যালোচনা করতে পারি। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছে। আর পারমাণবিক যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়েছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব সংঘাতের অবসান ঘটানো সম্ভব হয়েছে। আর সম্ভব হয়েছে বিশ্বে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যুগের সূচনা করা। সম্ভবত এটা একটা মহান অর্জন। ফ্যাসিবাদের ওপর বিজয়ের পর সম্ভবত এটি এই প্রজন্মের বৃহত্তম অর্জন।

ট্রাম্প ও তার নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ অর্জনগুলোকে অকার্যকর করতে চাইলে বিশ্ব পুনরায় আরেক স্নায়ুযুদ্ধের সম্মুখীন হবে এবং বিশ্ব ব্যবস্থায় পুনরায় উত্তেজনা ফিরে আসবে। এটি কখনও বিশ্বের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। আমেরিকার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষ চরম দরিদ্রতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। সমগ্র সম্পত্তি চলে যাচ্ছে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে। ভারসাম্য আনার চেষ্টা না করে বোমা বানানোর কথা বলে পুনরায় অস্ত্র প্রতিযোগিতার দিকে পা বাড়ালে আমেরিকার জন্য পরিস্থিতি সুখকর হবে না। আমরা অপেক্ষা করছি ভবিষ্যতে ট্রাম্প ও নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পিও বিশ্ব ব্যবস্থাটাকে কী করতে চায় তা দেখার জন্য।

জেরুসালেমে ইসরায়েল তার রাজধানী তেল আবিব থেকে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে, কিন্তু কোনও রাষ্ট্র তাদের দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুসালেমে নিতে সম্মত হয়নি। এখন ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন আমেরিকা তার দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুসালেমে সরিয়ে নেবে এবং স্থানান্তর অনুষ্ঠানে তিনি নিজে উপস্থিত থাকবেন।

দুনিয়ার ১৫০ কোটি মুসলমান এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের তার বন্ধু দেশগুলোও কিন্তু ট্রাম্প কোনও কথাই কানে নিচ্ছে না। ১১ সেপ্টেম্বর বারে বারে ফিরে আসা কী অসম্ভব? গত ১৫ বছর আফগানের কায়দায় আমেরিকার পা আটকা আছে, যা সরানো সম্ভব হচ্ছে না। ট্রাম্প নিজেই বলেছেন মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা ৮০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে নির্বোধের মতো কাজ করেছে। তিনি নিজেই কী বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে পুনরায় নির্বোধের মতো কাজ করছেন না!

লেখক: সাংবাদিক

anisalamgir@gmail.com