যারা বলেন, শিল্পীর কাজ হচ্ছে বিনোদন দেওয়া, আমি তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। বিনোদন দেওয়া বিনোদনকর্মীর কাজ, শিল্পীর নয়। সে অর্থে সংবিধানসম্মতভাবেই নিজেকে বিনোদনকর্মী ভাবতে পারেন। শিল্পী নয়। শিল্পীর কাজ শিল্প সৃষ্টি করা। নানা অভিব্যক্তির মাধ্যমে চিন্তার খোরাক জোগানো। শিক্ষাবঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষও ক্লান্তিময় দিন শেষে শুধু শিস বাজাতেই সিনেমা হলে যান, এমন সিদ্ধান্ত চিন্তাহীন মস্তিষ্কেরই প্রতিফলন। যে ভাবনার লেজুড় ইন্ডাস্ট্রি বয়ে বেড়াচ্ছে গত ৩ দশক ধরে। ফল শূন্য।
চলচ্চিত্র সম্পর্কে বলা হয়–শিল্পের সব শাখা যেখানে এসে মিলিত হয়, সেটি চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র বিনোদনেরও একটি বড় উৎস। কিন্তু বিনোদনও চিন্তাশীল হতে পারে। চলচ্চিত্রকে শুধু বিনোদনের মাধ্যম ধরে নিলে এর শক্তিমত্তার দিকটিকে খাটো করে দেখা হয়। পাশাপাশি একজন নির্মাতাকে (সংশ্লিষ্ট অনেককে) শুধু শিল্পের সব শাখার ওপরে দখল থাকলেই চলে না, তাকে যথেষ্ট প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন যেমন হতে হয়, তেমনি জীবন, সংস্কৃতি, ধর্ম ও দর্শনসহ সমাজ-রাজনীতির প্রায় সব বিষয়ে ধারণা থাকতে হয়।
উৎকট ফর্মুলার অর্থহীন অনুকরণ আর চিৎকার চেঁচামেচি চলমান রঙিন চিত্র হতে পারে। কিন্তু কিছুতেই শিল্প নয়। খুন-ধর্ষণের বিকৃত চিত্রায়ণ কখনও বিনোদন হতে পারে না। ভায়োলেন্স কখনও সুস্থ মানুষের বিনোদন হতে পারে না। পৃথিবীর সব দেশেই সিনেমা এখন জীবনের অনেক কাছাকাছি। যে চলচ্চিত্র-গল্পে, পোশাকে, চরিত্রে, চিত্রায়ণে কোনও সময়কে ধারণ করে না, কোনও ভাবনা ও বিশ্বাসকে ধারণ করে না, যে চলচ্চিত্রে কোনও সময়ের কোনও নৃতাত্ত্বিক প্রতিফলন থাকে না, সেটা কোনোমতেই কোনও সৃজনশীল কাজ নয়।
একটি ভঙ্গুর সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে থেকে সিনেমার দর্শককে চিন্তাহীন বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ফ্যান্টাসিতে রাখার চেষ্টা যে অমূলক, সেটা অনেক আগেই প্রমাণিত হয়েছে। তার চেয়ে বরং একটা ‘জীবন থেকে নেয়া’র শক্তিমত্তার কথা মনে রাখি। একটা ‘মুক্তির গানে’র প্রভাবের কথাও মনে করে দেখি।
রাষ্ট্র ও সরকারও সেটি মনে রাখুক। একটি জাতীয় চলচ্চিত্রকেন্দ্র এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দ্রুত প্রতিষ্ঠার সুমতি হোক। প্রতিটি জেলায়-উপজেলায় সিনেপ্লেক্সের উদ্যোগ বাস্তবায়ন হোক।
সমাজ যদি শরীর হয়, সংস্কৃতি তার মুখাবয়ব। একটি অসাম্প্রদায়িক ও শৃঙ্খলাপূর্ণ সমাজ আশা করলে সুস্থ সংস্কৃতি চচার্র সুযোগ রাখতে হবে। সংস্কৃতি প্রদর্শনের জায়গা রাখতে হবে। নয়তো অপসংস্কৃতি এসে যে সেই জায়গা দখল করবে, সেই সত্য এখন সবারই জানা।
শিল্প হিসেবে, দর্শন হিসেবে, দর্পণ হিসেবে চলচ্চিত্রের শক্তিমত্তার দিকটি বোঝার আগ্রহ হোক।
সবাইকে জাতীয় চলচ্চিত্র দিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা