সৌদি আরবের সংস্কার বিতর্ক

আনিস আলমগীরআরব বিশাল দেশ। সম্পূর্ণ এলাকাটা প্রায় মরুভূমি। স্থায়ীভাবে বসবাস করা লোক ছিল কম। যাযাবরই ছিল বেশি। উট আর ঘোড়া ছিল তাদের বাহন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে সমগ্র এলাকাটাই ছিল তুরস্ক সাম্রাজ্যের অধীন। আরব এলাকাটা হেজাজ আর নজদ- এই দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। তুরস্ককে বিভ্রান্ত রাখার জন্য ব্রিটিশরা মক্কায় হোসেন শরিফকে এবং হেজাজে ইবনে সৌদকে সহায়তা দিয়েছিল, তারা যেন তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অব্যাহত রাখে।
হোসেন শরিফ শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেননি। ইবনে সৌদই এলাকাটা অধিকার করে বসেন এবং নিজে হেজাজ ও নজদের বাদশাহ হন। অবশ্য ব্রিটিশরা হোসেন শরিফের দুই ছেলে ফয়সাল এবং আবদুল্লাহকে ইরাক ও জর্দানের সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। ইরাকে বাদশাহ ফয়সালের রাজত্বের অবসান হলেও জর্দানে আব্দুল্লাহর বংশের রাজত্ব এখনও টিকে আছে।
ইবনে সৌদ ১৯২৬ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ হেজাজ আর ১৯৩০ সালের মধ্যে পুরো নজদ দখল করেছিলেন। ইবনে সৌদ ছিলেন একটা বিশেষ দল বা সম্প্রদায়ের নেতা। এ সম্প্রদায়টির নাম ওহাবি সম্প্রদায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী এই ওহাবি মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা। মূলত ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধনের প্রয়োজনে ছিল এই আন্দোলন। অনেকটা খ্রিস্ট ধর্মের পিউরিটানদের মতো।

মুসলমানদের মধ্যে যখন পীর পূজা, কবর পূজার রেওয়াজ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এ আন্দোলনের সূচনা। ওহাবিরা বলতো এ সবই পৌত্তলিকতা। তখন অবস্থা এমন হয়েছিল যে মসজিদে নববীতে যখন কোনও ওয়াক্তের নামাজের জামাতে মুসল্লি হতো ৬০/৭০ জন, তখন কিন্তু হজরত ফাতেমা (র.)-এর জান্নাতুল বাকি গোরস্থানের মাজারে মানুষ উপস্থিত থাকতো ১০/১২ হাজার। তারা নামাজ আদায় করার চেয়ে মাজারে বসে থাকাই উত্তম মনে করতেন।

ইবনে সৌদ যখন হজরত ফাতেমা (র.)-এর মাজার ভেঙে ফেলেন তখন নাকি গম্বুজ থেকে ২১ মণ স্বর্ণ পেয়েছিলেন। আসলে মনে হয় তখন ওহাবিরা সংস্কার আন্দোলনটা না করলে ইসলাম পৌত্তলিকতায় ফিরে যেত। অবশ্য মহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব বড় একজন সংস্কারক হলেও তিনিও কিছু ভাড়া বাড়িতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ইবনে সৌদ বুদ্ধিমান নরপতি ছিলেন। তিনি যাযাবর বেদুইনদের স্থায়ী বসবাসের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ কাজে পরিপূর্ণ সফল না হলেও ব্যাপক সংখ্যক বেদুইনকে স্থায়ীভাবে বসতি করাতে পেরেছিলেন। রেললাইন স্থাপন, প্লেন সার্ভিস চালু করা ইত্যাদি ছিল তার কৃতিত্ব।

বিভিন্ন পথে হজযাত্রীদের কাফেলায় ডাকাত দলের উপদ্রপের কারণে হজযাত্রীর সংখ্যা কমে গিয়েছিল। ইবনে সৌদ হজযাত্রীদের পথে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। এখন পর্যন্ত ইবনে সৌদের পুত্র-পৌত্রগণই সৌদি আরব শাসন করে আসছেন। বর্তমান বাদশা হচ্ছেন সালমান ইবনে সৌদ আর ক্রাউন প্রিন্স হচ্ছেন মোহাম্মদ বিন সালমান।

সৌদি আরবে এখন প্রকৃত ক্ষমতা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের হাতে। যুবরাজ মোহাম্মদ ব্যাপক সংস্কারের পথে হাঁটছেন। এত দ্রুত সংস্কারের আয়োজন করা সঠিক হলো কিনা বলা মুশকিল। ফ্রান্সের সম্রাট লুই তাড়াহুড়া করে সংস্কার করতে গিয়ে ১৭৯৩ সালে ফরাসি বিপ্লব ডেকে এনেছিলেন। সম্রাট লুই নিজেকেও বাঁচাতে পারেননি গিলোটিনের হাত থেকে। সংস্কার প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার উদ্যোগ নেয়, তাই অনেক সময় সমাজের প্রতিরোধের মুখে পড়ে।

তুরস্কে যখন কামাল আতাতুর্ক ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তখনও যে তিনি বাধার মুখে পড়েননি তা নয়। তিনি বলতেন—‘যা পচে গেছে, যা মরে গেছে তাকে সিল্কের কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রেখে লাভ কি? তেমন জিনিস যদি আমাদের অতি প্রিয় জিনিসও হয় তবুও তাকে কবর দিয়ে আমাদের এগিয়ে চলতে হবে। জীবন মানে এগিয়ে চলা।’

কামাল আতাতুর্ক পৃথিবীর অনেক সফল মানুষের একজন। তিনি সফল হয়েছেন সত্য কিন্তু অনেকের ব্যাপারে অঘটন ঘটেছে। ১৯৮০ সালের সোভিয়েত ইউনিয়নের মিখাইল গর্ভাচেভ আমূল সংস্কার আনতে উদ্যোগী হলেন, কিন্তু শেষ পরিণতিতে ১৯৯১ সালে সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

সৌদি আরব ওহাবি মতবাদের ওপর ভিত্তি করে দেশ চালিয়েছে নয় দশক। ইমাম খোমেনি গত শতাব্দীর আট দশকে ইরানে বিপ্লব করে সংস্কার এনেছিলেন। সেই সংস্কার নারীদের হিজাব পরিয়েছে আর এই শতাব্দীর দুই দশকে সৌদি যুবরাজ হিজাব ফেলে গাড়ি চালিয়ে নারীকে সিনেমায় যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে। কারটা সঠিক আর কারটা বেঠিক সময়েই বলবে।

সৌদি আরবে মক্কা শরিফ আর মদিনা শরিফের অবস্থান। ১৫০ কোটি মুসলমানের তীর্থ। তার পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব তাদের হাতে থাকবে কিনা তার একটা প্রশ্নই অচিরেই মুসলিম বিশ্বে উত্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে তেলের বিকল্প আয়ের অনুসন্ধান করছে যুবরাজ মহাম্মদ বিল সালমান। এটাই তার উত্তম চিন্তা। সৌদি আরব শিল্পে উন্নত হলে মুসলিম বিশ্বে গরিব দেশগুলোর মানুষের চাকরির ব্যবস্থাও হবে আর সৌদি আরবের আয়ের বিকল্প পথও উন্মোচিত হবে।

সৌদি আরব হচ্ছে নয় লক্ষ বর্গমাইল এলাকা। বিরাট এলাকা কিন্তু তাদের নিজস্ব লোক সংখ্যা দেড় কোটির উপরে নয়। সৌদি আরবের শিল্পের পাশাপাশি কৃষি উন্নয়নের চিন্তা করাও ভালো ছিল। মিঠা পানির রিজার্ভার সৃষ্টি করে সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনের চেষ্টা করা যেত। রিজার্ভার সৃষ্টিটা ব্যয়বহুল হলেও সৌদির হাতে সে বিনিয়োগ করার অর্থ তো রয়েছে। বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ইতিহাস পড়লে দেখা যায় কত সুজলা-সুফলা ভূমি মরুময় হয়ে গেছে আবার কত মরুময় ভূমি সুজলা-সুফলা হয়েছে।

যুবরাজের সঙ্গে ইসরায়েলের সুসম্পর্ক সম্ভবত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে কারণে ফিলিস্তিনের ভূমির ওপর ইহুদিদের অধিকারের কথা তিনি বলেছেন। আবার সঙ্গে সঙ্গে তার পিতা বাদশাহ সালমান ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে তাদের অব্যাহত সম্পর্কের কথাও উল্লেখ করেছেন। সৌদি আরবের বাদশাহ দুই হেরেমের খাদেম একথা বিস্মৃত হলে চলবে না। কোনও মুসলিম দেশের প্রতি তার বৈরিতা মানায় না। ভ্যাটিকানের মতো তার স্পিরিচ্যুয়াল লিডারশিপের ভূমিকা পালন করা উচিত।

যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান পশ্চিমা বিশ্বের জীবনের রীতিনীতি অনুসরণ করতে চাচ্ছেন। তিনি বিকল্প আয়ের পথ সৃষ্টির জন্য সমুদ্র উপকূলে ফ্রান্সের সমুদ্র উপকূল মোনাকোর মতো বিনোদনকেন্দ্র স্থাপনের কথা বলেছেন। মোনাকো হচ্ছে পশ্চিমা বড়লোকদের মনোরঞ্জনের জায়গা। সৌদি আরবে এটা শোভনীয় হবে মনে হয় না।

সৌদি আরব এত বছরব্যাপী শাসিত হয়েছে শরিয়া আইন দিয়ে। এখন সংস্কার যে পথে চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে শরিয়া আইনের সঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে বিরোধ হবে। সুতরাং মোহাম্মদ বিন সালমানের উচিত হবে একটা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা। সৌদি আরবের কোনও শাসনতন্ত্র নেই। তাদের শাসনতন্ত্রের কথা বললে তারা আল কুরআনের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে। তাদের বর্তমান সংস্কার তো আল কুরআনের অনুসরণে নয়। পশ্চিমা দুনিয়ার ধ্যান-ধারণাকে ভিত্তি করে। অথচ আল কুরআনের অনুসরণেও আধুনিক সমাজ গঠন করা যায়। অবশ্য অভিযোগ আছে এতদিন তারা শরিয়া আইনও অনুসরণ করেছেন তাদের খেয়াল-খুশি মতো। বায়তুল মাল বা রাষ্ট্রীয় ট্রেজারি ছিল তাদের পারিবারিক মালিকানায়, যা শরিয়া আইনে অচল।

রোমের রাষ্ট্রদূত হজরত ওমর (র.)-এর সঙ্গে দেখা করেছিলেন এক খেঁজুর গাছের নিচে। রাজপ্রাসাদের কোনও কথা শরিয়া আইনে নেই। সৌদিরা তো তাদের প্লেনে উঠার জন্য সিঁড়ি তৈরি করেছেন স্বর্ণ দিয়ে। শাসকের অনুরূপ বিলাসিতা শরিয়া আইন সমর্থন করে না। হজরত ওমর ইফতার করতেন ৫/৬টা খেজুর আর এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দিয়ে।

আধুনিকতার অনাচার থেকে দুই হেরেমকে বাঁচানোর জন্য হেরেম শরিফ দুটির রক্ষণা-বেক্ষণের জন্য এখন তারা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নিয়ে একটা কাউন্সিল গঠনের পুরনো যে দাবি সেটাকে বিবেচনা করতে পারে। নয়তো যুবরাজ মোহাম্মদ মুসলিম বিশ্বের চাপের মুখে পড়বেন। যে পশ্চিমাদের কথায় মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবকে আধুনিক করে গড়ে তোলার অভিলাষ পোষণ করছেন–তারা তাকে ক’দিন পর বাইবেলের মতো কুরআনের ভার্সান বদলানোর পরামর্শও দিতে পারে। কারণ, ঐতিহাসিক মুর বলেছেন কুরআন একটা অগ্নিপিণ্ড।

লেখক: সাংবাদিক

anisalamgir@gmail.com