কোটা সংস্কার আন্দোলন, কোটা বাতিল এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী রাজনীতি

বিভুরঞ্জন সরকারসরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে গত কয়দিন দেশজুড়ে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ হয়েছে। শুধু রাজধানী ঢাকায় নয়,মোটামুটি সারাদেশেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। হঠাৎ করে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন এতটা ব্যাপকতা লাভ করবে কেউ সেটা ভাবতে পারেননি। সরকারের গোয়েন্দা বিভাগগুলোর কাছেও সম্ভবত সে রকম রিপোর্ট ছিল না। কোটা সংস্কারের দাবির পক্ষে কিভাবে যেন একটি ব্যাপক সমর্থন গড়ে ওঠে। প্রায় সবাই বিষয়টিকে সমর্থন করেন।
বলা হয়,এই দাবি ন্যায়সঙ্গত। কোটা ব্যবস্থার কারণে নাকি প্রকৃত মেধাবীরা সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে।
কোটার কারণে মেধাবীরা চাকরিবঞ্চিত হচ্ছে– এই অভিযোগটি একেবারেই অসাড়, ভিত্তিহীন। কারণ যারা কোটায় চাকরি পাচ্ছেন তাদেরও লিখিত পরীক্ষায় পাস করতে হচ্ছে। কোটার ভিত্তিতে লিখিত পরীক্ষায় পাস করানো হয় না। এটা ঠিক যে আমাদের দেশে অসংখ্য তরুণ-যুবক বেকার,কর্মহীন। দুই হাজার শূন্য পদ পূরণের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করলে আবেদনপত্র জমা হয় কয়েক লাখ। কোটাটা আমাদের দেশে বড়ো সমস্যা নয়, বড়ো সমস্যা হলো ব্যাপক কর্মসংস্থানের অভাব। কোটা সংস্কার করলে কিছু চাকরিপ্রার্থীর হয়তো কাজ জুটবে, তাতে সমস্যার পাহাড় কমবে না। তাছাড়া কোটার কারণে যারা চাকরি পান তাদের ঢালাওভাবে একেবারে মেধাশূন্য বলাটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকারীরা যদি ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, সরকারি চাকরিতে নতুন পদ সৃষ্টি করা, বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারিত করার জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা এবং সর্বোপরি ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধেও দাবি তুলে ধরতো তাহলে সেটা হতো সবদিক থেকেই ভালো। কোটা ব্যবস্থা না থাকলেও দেশে বেকারত্ব ঘুচবে না।
তারপরও যেহেতু কোটা সমস্যার বিষয়টি সামনে এসেছে সেহেতু এটার পর্যালোচনা, পুনর্মূল্যায়ন করা ছিল সময়ের দাবি। কোটা ব্যবস্থাটা নতুন কিছু নয়। বর্তমান সরকারও এটা চালু করেনি। আমাদের সংবিধানের আলোকেই কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। দুনিয়ার বহু দেশেই কোটা প্রথা আছে। বিশেষ করে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়।
বাংলাদেশে অবশ্য মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যও কোটা ব্যবস্থা আছে এবং সংখ্যায় বেশি – শতকরা ৩০ ভাগ। নারী ১০ ভাগ, পার্বত্য অঞ্চল, শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং অন্যান্য মিলে ১৬ শতাংশ, মোট ৫৬ শতাংশ।
এখন কারো কারো কাছে এই কোটাটা বেশি মনে হচ্ছে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, অন্য কোটা নিয়ে যতটা নয়, তারচেয়ে বেশি আপত্তি মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে। এটাও ঠিক যে স্বাধীনতা লাভের ৪৭ বছর পর আর কোনও মুক্তিযোদ্ধার চাকরির বয়স নেই। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ ভাগ সংরক্ষণ থাকবে। মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিদেরও কেন এই সুবিধা দেওয়া হবে। যুগ যুগ ধরে এই ব্যবস্থা চালু থাকলে সমাজে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হবে,অথচ মুক্তিযুদ্ধের একটি মূলনীতি হলো বৈষম্যহীনতা।
এসব কথায় যুক্তি নেই তা বলা যাবে না। তাই যখন কোটা সংস্কারের দাবিটি সামনে আসে তখনই সরকারের উচিত ছিল বিষয়টি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা। পরিবর্তী সময় ও অন্যান্য বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার মতামতের ভিত্তিতে সংস্কারের পথে অগ্রসর হওয়া। কিন্তু আমাদের সরকারগুলো চলে গদাইলস্করি চালে। কানের কাছে বিপদের ঘণ্টাধ্বনি না বাজলে কোনও সরকারেরই টনক নড়ে না। বর্তমান সরকারেরও নড়েনি। সরকার শুরুতে উদ্যোগ নিলে হয়তো কয়েকদিনের জনদুর্ভোগ থেকে রেহাই পাওয়া যেত।
বিএনপি নেতারা এখন চড়া গলায় বলছেন,কোটা সংস্কারের দাবি ন্যায়সঙ্গত। জনাবেরা, আপনারা যে এতো এতো বছর ক্ষমতায় ছিলেন, তখন এই ন্যায় বোধ কোথায় ছিল? নাকি তখন এই কোটা প্রথা ছিল না? ঝোপ বুঝে কোপ মারার রাজনীতি সমস্যা কমায় না, বাড়ায়।
ইস্যুটির প্রতি অনেকেরই সমর্থন আছে বুঝতে পেরে আন্দোলনে যে ‘রাজনীতি' ঢুকে পড়েছিল সেটা বোঝার জন্য গবেষক হওয়ার প্রয়োজন হয় না। কোটা ব্যবস্থা রাখা না-রাখার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচর্যের কোনও সম্পর্ক নেই। তারপরও তার বাসভবনে গভীর রাতে হামলা করা, ভাঙচুর, লুটপাট করা – এগুলো মেধাবী শিক্ষার্থীদের কাজ? নাকি মতলববাজ রাজনৈতিক ক্যাডারদের কাজ? চারুকলায় হামলা করে পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রার জন্য প্রস্তুত জিনিসপত্র ভাঙচুর করলো ক্ষুব্ধ মেধাবী সাধারণ শিক্ষার্থীরা?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্দোলনের সূতিকাগার বলা হয়। কত আন্দোলনের ঐতিহ্য বহন করছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। কেউ কখনও শুনেছেন, আন্দোলনকারী উপাচার্যের বাসভবনে হামলা করেছে?
কেউ কেউ বলছেন, পুলিশ কেন টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করলো? যেন বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পৃথিবীর কোথাও আগে পুলিশি অ্যাকশন হয়নি। একটি ব্যস্ত সড়ক ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবরোধ করে রাখা হবে। সাধারণ মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটবে আর পুলিশ নির্বিকার থাকবে, তাই কখনও হয়? পুলিশের বাড়াবাড়ি যেমন সমর্থন করা যায় না, তেমনি আন্দোলনকারীদের উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডও মেনে নেওয়া উচিত নয়। কোনও পক্ষেরই কোনও দায়িত্বহীন আচরণ করা ঠিক নয়।
আন্দোলনকারীরা বঙ্গবন্ধুর নামে স্লোগান দিয়েছে, জয় বাংলা স্লোগান দিয়েছে বলে বলা হচ্ছে এরা তো সরকার সমর্থক। স্লোগান শুনেই তাদের রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে রায় দেয়া উচিত নয় । বিভ্রান্ত করার জন্যও কখনও কখনও এমন করা হয়ে থাকে। ১৯৭৪ সালে ডাকসু নির্বাচনের ব্যালট বাক্স ছিনতাই করার সময় স্লোগান দেওয়া হয়েছিল ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র জিন্দাবাদ’। কিন্তু কাজটি করেছিল ছাত্রলীগ। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের কর্মী-সমর্থক থাকতেই পারে, কিন্তু ওখানে যে সরকারবিরোধীরাও সংঘবদ্ধভাবে জমায়েত হয়েছিল, সেটাও ঠিক। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকরা সুযোগ নিয়েছে। আমি যেহেতু নিজে ছাত্র আন্দোলনের কর্মী ছিলাম সেহেতু ‘সাধারণ ছাত্র’দের নামে যেসব আন্দোলন হয়, সেসবের পেছনে আসলে কারা থাকে তা আমি জানি। আমাদের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনের এক নেতা এখনকার বিএনপি নেতা শামসুজ্জামান দুদু।
এবার কোটা সংস্কার আন্দোলেনে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে জামায়াত। তারা সাধারণ ছাত্র নামে ঢুকে তাদের সাংগঠনিক ‘প্রতিভার'  স্বাক্ষর রেখেছে। স্বাধীনতা লাভের পরও তারা এই কৌশলেই কাজ করেছে। জাসদের সেসময় রমরমা অবস্থার পেছনে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির অবদান ছিল বলে আমার বিশ্বাস। জিয়া তাদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দিলে জাসদ দুর্বল হয়ে পড়ে। কোটা আন্দোলনের সুযোগে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যেভাবে সংগঠিত প্রচারণা চলেছে, তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। মনে হয়, কোটা প্রথা প্রবর্তনের দায় বুঝি মুক্তিযোদ্ধাদেরই। কোটার বিরোধিতা করতে গিয়ে এমন সব কুযুক্তি সামনে আনা হয়েছে যেগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অসম্মানজনক। মুক্তিযোদ্ধারা নিশ্চয়ই বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য জীবনমৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে অস্ত্র হাতে তুলে নেননি। যারা নানা বিবেচনায়, আগপিছ নানা কিছু ভেবে মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি অংশ নেননি, তাদেরই বেশি সোচ্চার দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-উপহাস করতে।
এবার মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী জামায়াত এবং তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বিএনপি ভর করেছে ‘সাধারণ' ছাত্রদের ওপর। তারা এখন রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। তাই যেখানেই আগুন দেখবে সেখানেই আলু পোড়ানোর সুযোগ তারা নিতে চাইবে – এটাই স্বাভাবিক। তারা এটা নিয়েছেও। সম্ভবত বিএনপি-জামায়াতের প্রভাবেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আলোচনায় বসে আন্দোলনকারীরা সমঝোতায় এসে আন্দোলনের কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অবস্থান পরিবর্তন করে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। একটি নীতি সংস্কার করতে হলে তার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন হয়। সেজন্য সময় দরকার। এক মাস সময় নিয়েছিল সরকার। কিন্তু আন্দোলনকারীরা এই সময় দিতে নারাজ। কারণ কী? আসল কারণ তারা সমস্যার সমাধান চায় না, সমস্যাকে গভীরতর করে দেশে একটি সংকট তৈরি করতে চায়।
আন্দোলন অব্যাহত থাকায় এবং আন্দোলনের নামে পথঘাট বন্ধ করে মানুষকে অশেষ দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে তিনি পিছিয়ে পড়াদের জন্য বিশেষ কি করা যায় সেটা ভাবার কথাও বলেছেন।
এখন আবার শুরু হয়েছে উল্টো গীত। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী অভিমান করে এই ঘোষণা দিয়েছেন। কেউ বলছেন তিনি রাগ করেছেন। কোটা বাতিল তো কেউ চায়নি। সংস্কার চেয়েছে। মাথা ব্যথার জন্য তো মাথা কেটে ফেলা ঠিক না। কিন্তু সরকার যখন বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এক মাস সময় চাইলো তখন আন্দোলন অব্যাহত রাখা যে যৌক্তিক হয়নি – এটা কিন্তু কাউকে বলতে শুনছি না। প্রধানমন্ত্রী যদি সংস্কারের কথা বলতেন তাহলে বলা কতটুকু সংস্কার সেটা বলতে হবে।
‘কোটা’কে যেহেতু মেধাবীদের জন্য বড়ো বাধা হিসেবে দেখা হয়েছে সেহেতু কোটা বাতিলের ঘোষণা অসঙ্গত হয়নি। এখন ছাত্ররা শান্ত হয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হোক আর সরকারও তার সংবিধান রক্ষার অঙ্গীকার পালনে অগ্রসর হোক। সংবিধান যেহেতু অনগ্রসরদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার পক্ষে সেহেতু কিভাবে সেটা কার্যকর বা বাস্তবায়ন করা যায় তার উপায় সরকারকেই বের করতে হবে। সেটা করতে গিয়ে যেন আবার কালক্ষেপণ বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা না হয়। একটা যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যেই এটা করতে হবে। যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায় তাদের পানি ঘোলা করার সুযোগ দেওয়া যাবে না।

লেখক: কলামিস্ট