আমরা এমন এক নষ্ট সময় পার করছি, যে সময়ে খুব কম লোকই নিজেকে নিরাপদ মনে করে। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় শিশুর ওপর পাশবিক নির্যাতনের বীভৎস সংবাদ। সম্প্রতি যে সংবাদটি আমাদের ভীষণভাবে পীড়া দিয়েছে তা হলো, ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের কাঠুরা গ্রামের ৮ বছর বয়সী শিশু আসিফাকে স্থানীয় মন্দিরের দেখাশোনার দায়িত্বরত কিছু লোক অপহরণ করে মন্দিরে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে। ওই লোকেরা শুধু এতটুকুতেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা মেয়েটিকে হত্যা করে মন্দিরের পাশের একটি ঝোঁপে ফেলে দেয়।
ঘটনাটি যদি এখানেই থেমে যেতো, তাহলে হয়তো চলমান পৃথিবীর আরও আট-দশটি ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের মতো একসময় সবার স্মৃতির আড়ালে চলে যেতো। হয়তো ধর্ষক ও খুনিদের প্রচলিত আইনে বিচার হতো কিংবা হতো না। নিত্যনতুন ইস্যুর ডামাঢোলে বিষয়টি সাধারণের চাঞ্চল্য হারিয়ে অতীতের অংশ হতো।
কিন্তু এখানে তা হয়নি ভিন্ন এক কারণে। সেটা হলো, শিশু আসিফার ওপর মন্দিরের বুড়ো পুরোহিত ও তার সহযোগীদের দিনের পর দিন ধর্ষণ ও পরবর্তী সময়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের এই ঘটনার পরপরই ভারতে এমন কিছু সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছে, যা দেখে বিশ্বের বিবেকবান মানুষেরা স্তম্ভিত ও ক্ষুব্ধ।
যেহেতু ধর্ষণটি ঘটেছে একটি মন্দিরে এবং ধর্ষণের সঙ্গে সরাসরি মন্দিরের পুরোহিত ও তার আত্মীয়-স্বজন জড়িত; সেহেতু একটি বিশেষ মহল এই নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ওপর সাম্প্রদায়িকতার রঙ মাখতে চেয়েছে। তারা পদে পদে আইনি প্রক্রিয়ার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের বিশাল একটি কমিউনিটি এই বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে এসেছে। আগুন জ্বালিয়ে, স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত করে দেশে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির হুমকি দিচ্ছে। অন্যায়ের পক্ষে তাদের এই সাম্প্রদায়িক অবস্থান বিশ্বের বিবেকবান মানুষদের আহত করছে।
আমরা যদি এই ঘটনার সমান্তরালে খুব অল্প ক’দিন আগে ঘটে যাওয়া আরেকটি ঘটনাকে তুলনা করি, তাহলে হয়তো অবাক না হয়ে পারবো না। মাসখানেক আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে একটি দাঙ্গা হয়েছে। সেই দাঙ্গায় সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের চারজনের মৃত্যুর সংবাদ আমরা পেয়েছি। সেই নিহতদের একজন হচ্ছেন সেখানকার স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম মুহাম্মদ ইমদাদুল্লাহ রাশিদির ছেলে। তিনি যখন দেখলেন তার ছেলের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিহিংসার খেলা শুরু হতে পারে, তখন তিনি অসাধারণ উদারতা দেখিয়ে পুরো মুসলিম কমিউনিটিকে শান্ত থাকার আহ্বান জানালেন। তিনি মৃত্যুকে সাম্প্রদায়িক রূপ না দিয়ে বৃহত্তর স্বার্থে উন্মুক্ত ক্ষমার ঘোষণা জানিয়ে দিলেন। তার একটি মাত্র আহ্বান থামিয়ে দিলো আরেকটি রক্তগঙ্গা। তিনি ইচ্ছে করলে ছেলের নৃশংস হত্যার বিচার চাইতে পারতেন। এটি তার আইনি অধিকারও বটে। কিন্তু তিনি সেই পথে যাননি; বরং শান্ত ভারত গড়ার বৃহত্তর স্বার্থে জলাঞ্জলি দিলেন নিজের প্রাপ্য অধিকার।
এটাই ইসলামের শিক্ষা। ইসলাম তো সারা পৃথিবীর মানুষকে ভালোবাসতে বলে। ইসলাম তো যুদ্ধের ময়দানেও নারী ও শিশুদের ওপর অস্ত্র প্রয়োগ করতে নিষেধ করে। আপনি বলুন, আসানসোলের ওই ইমাম সাহেব নৈতিকতা ও উদারতার এ শিক্ষা কোথায় পেয়েছেন? ইসলাম থেকেই পেয়েছেন। ইসলামই তাকে রক্তপাত এড়িয়ে সৌহার্দ্যমূলক সহাবস্থানের শিক্ষা দিয়েছে। আজ যদি তারাও আসিফার খুনিদের বেলায় সেই সাম্প্রদায়িক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বিবেকের মাপকাঠি দিয়ে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতো, তাহলে নোংরা সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট রাজনীতির এমন বীভৎস দৃশ্য আমাদের দেখতে হতো না।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ধর্ষণ নিয়ে এমন নোংরা রাজনীতি যদি শুধু অনগ্রসর, অশিক্ষিত ও উগ্র লোকেরাই করতো, তাহলে আমরা এতটা সংক্ষুব্ধ হতাম না। কিন্তু এখন অনেক শিক্ষিত মানুষও এই রাজনীতির অংশ হয়েছেন।
তসলিমা নাসরিন বিষয়টি নিয়ে লিখিত অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। লেখাটিতে তিনি ধর্ষণের এই ঘটনাটিতে মূল অপরাধী ও তাদের পক্ষে নেমে আসা সাম্প্রদায়িক শক্তির বর্বরতাকে লঘু করার চেষ্টা করেছেন। যেখানে একজন নাগরিক হিসেবে তার দায়িত্ব ছিল নিপীড়িতদের পক্ষে কথা বলা এবং অপরাধী যেই হোক, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, সেখানে তিনি উল্টো নির্যাতিত আসিফার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কথা বললেন।
তার দায়িত্ব ছিল মূল অপরাধীর অপরাধকে লঘু করে না দেখে অপরাধ-পরবর্তী সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের বিরোধিতা করা, কিন্তু তিনি অপরাধীর অপরাধকে লঘু করার জন্যে ভিকটিমের ধর্ম ও ধর্মের মহান মনীষীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। যা নিঃসন্দেহে অন্যায়। একটা কথা মনে রাখতে হবে, ধর্ষকদের কোনও ধর্ম নেই। ইসলামেও ধর্ষকের বিরুদ্ধে চরম শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
তসলিমা নাসরিন বরাবরই যেকোনও ইস্যুতে ধর্মকে টেনে আনতে ভালোবাসেন এবং গোঁজামিল তৈরি করেন। এক্ষেত্রে তিনি তার বিবেক, নৈতিকতা ও নাগরিক দায়বদ্ধতাকে বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করেন না।
বড় ভালো হতো, তিনি যদি আট বছরের ছোট্ট শিশু আসিফা ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ইস্যুটিকেও তার ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর হাতিয়ার না বানাতেন।
তসলিমা নাসরিনের বক্তব্য দেশের অনেকের মনে আঘাত দিয়েছে। তিনি এই নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে মুখ খুলবেন কি খুলবেন না, সেই স্বাধীনতা তার আছে। কিন্তু সেখানে ধর্মকে আঘাত করলে তো ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আঘাত পাবেই।
আমরা চাই, প্রতিটি মানুষ দেশের প্রতি, দেশের নাগরিকের প্রতি, নিজ বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি করবেন।
লেখক: অনুবাদক ও শিক্ষক