এবার আসা যাক অপর পক্ষের অবিমৃশ্যকারিতার বিষয়ে। ফেসবুকসহ পত্রপত্রিকায় প্রচারিত হচ্ছে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের কয়েকজন অতীতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং একজন হলেন কুখ্যাত রাজাকারের নাতি। প্রশ্ন হচ্ছে, এ আন্দোলন তো একদিনে এই রূপ ধারণ করেনি। বেশ কয়েক মাস ধরে আন্দোলন চলছিল। তখন কেন এ তথ্য প্রকাশ করা হলো না? কেন সদবিশ্বাস নিয়ে আন্দোলনের সাথে যুক্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের এদের বিষয়ে তথ্য প্রদান করা হলো না যাতে তারা বিভ্রান্ত না হয়? আন্দোলনকারীদের সংখ্যা দেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কেন আনুমান করতে পারলেন না ভিমরুলের চাকে আঘাত করলে কি হতে পারে? আমাদের রুগ্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে প্রতিপক্ষ যেকোনও আন্দোলন থেকেই জায়েজ-নাজায়েজ বাছ-বিচার না করেই সুবিধা নিতে চেষ্টা করবে, এটা বুঝার জন্য রকেটবিদ্যার প্রয়োজন পড়ে না। আর যদি আগে থেকেই অনুমান করে থাকি যে বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনকারীদের উস্কে দিচ্ছে তাহলে তো আরও সচেতন কেন হলাম না? কোনরূপ শক্তি প্রয়োগ করলে তা যে শত্রুপক্ষের জন্যই সুবিধা এনে দিবে এটা কেন অনুধাবন করতে পারলাম না? প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর যখন পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এসেছে, তখন আন্দোলনকারীদের তিনজনকে চোধ বেঁধে মাইক্রোবাসে অজ্ঞাত গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া যে ছাইচাপা আগুনে বাতাস দিয়ে উস্কে দেয়া, তা কেন করা হলো? কার স্বার্থে এত বড় অবিমৃশ্যকারিতা করা হলো? কোথাও আগুন লাগলে প্রথম কাজ হচ্ছে আগুন পুরোপুরি নিভানো। আগুনকে উস্কে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কোন নিয়ম-নীতি না মেনে আন্দোলনবিরোধী একজন ছাত্রীকে তাৎক্ষণিক বহিষ্কার ও পরবর্তীতে সেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে আমাদের অনেক দৈন্যতারই ইঙ্গিত দেয়। একবার আন্দোলনকারীদের সাথে আবেগী একাত্মতা এবং তার চূড়ান্ত রূপ দিতে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বহিষ্কার, আবার প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব অনুভব করে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া মোটেও ভালো কথা নয়। আন্দোলন থিতু হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানোর অভিযোগ এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হল থেকে গভীর রাতে কয়েকজন ছাত্রীকে বের করে দেওয়া, মেয়েদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া, প্রাধ্যক্ষের হুমকি দেয়া চরম অবিবেচকের মতো সিদ্ধান্ত হয়েছে। মেয়েদের হল থেকে বের করে দেয়ার বিষয়ে সুফিয়া কামাল হলের প্রভোস্ট ড. সাবিতা রেজওয়ানা রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এশা একজন শিক্ষার্থীর রগ কেটে দিয়েছিল বলে যে গুজব ১০ এপ্রিল ছড়ানো হয়েছিল, মোবাইল ফোন চেক করে ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করেছি। যারা ওই ঘটনায় জড়িত ছিল, তাদের অভিভাবকদের হলে ডেকেছি। তাদের (অভিভাবকদের) ওই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভিডিওগুলো দেখানো হয়েছে। তখন অভিভাবকরা নিজেরাও লজ্জা পেয়েছেন এবং তারা স্বেচ্ছায় তাদের মেয়েদের নিয়ে গেছেন। একই দাবি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘মেয়েদের বের করে দেওয়া হয়নি। তিন ছাত্রীকে অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বের করে দেওয়ার কথাটা গুজব। এর মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। হল থেকে কাউকেই বের করে দেওয়া হয়নি। হলের সম্মানিত প্রাধ্যক্ষ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের কাছে আমার সবিনয় জিজ্ঞাসা– এক. বের করে দেয়ার আগে স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের নীতি অনুযায়ী তাদের কারণ দর্শাও নোটিশ প্রদান ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়েছে কিনা? নাকি এশার মতো তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হয়েছে? দুই. অভিভাবকের কাছেই যদি দিতে হয়, রাতের বেলায় কেন? যেখানে বাবার সামনে থেকে মেয়েকে, ভাইয়ের সামনে থেকে বোনকে, স্বামীর সামনে থেকে স্ত্রীকে জবরদস্তি নিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে সেখানে গভীর রাতে একজন অভিভাবককে একজন মেয়ে শিক্ষার্থীকে নিয়ে যেতে বাধ্য করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? এত রাতে রাস্তায় অপ্রীতিকর কোন ঘটনা ঘটলে তার দায় কে নিতো? তিন. গুজব ছড়ানোর মতো এত বড় অপরাধের জন্য কেবল বের করে দেয়া কেমন শাস্তি হলো? তদুপরি, এ গুজবের সূত্র ধরে একজন ছাত্রীকে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ মানব মর্যাদার জন্য অবমাননাকর শাস্তি জুতার মালা পরানো হলো, তাকে হেনস্তা করা হলো, তার শাস্তি কেবল হল থেকে বহিষ্কার? তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা করে তাদের পুলিশের হাতে তুলে না দিয়ে গভীর রাতে হল থেকে বহিষ্কার কেন?
ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে ‘এনাফ ইজ এনাফ’। যথেষ্ট হয়েছে, সবাই এবার দয়া করে থামুন। একটি জাতীয় দৈনিকসহ কোন কোন মহল উস্কানি দিচ্ছে কোটা সংস্কার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সংসদে প্রদত্ত বক্তব্য বিষয়ে এখনও প্রজ্ঞাপন কেন জারি হচ্ছে না। সকলের আবগতির জন্য বলছি, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা কার্যকর করার লক্ষ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করতে বেশ কয়েকটি ধাপ পেরুতে হবে। বিষয়টির সঙ্গে স্পিকার ও সংসদ সচিব, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও কেবিনেট সচিব সংশ্লিষ্ট। প্রধানমন্ত্রী সংসদের অধিবেশনে ঘোষণা দেয়ায় এটি এখন ‘সংসদে সরকারি ঘোষণা বা প্রতিশ্রুতির’ অংশ। ফলে এটি জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ২৪৪ বিধির আলোকে ‘সরকারি প্রতিশ্রুতি সংক্রান্ত কমিটি’-তে যাবে। কমিটির সুপারিশের আলোকে সংসদ সচিবালয়ের সচিব প্রস্তাবটি সুনির্দিষ্ট আকারে তৈরি করে স্পিকারের অনুমোদন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের কাছে পাঠাবেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত ‘পরিপত্রের’ আলোকে সংসদ সচিবালয়ের প্রস্তাবটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাস্তবায়নের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবেন। এরপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাই করে কোটা বাতিল সংক্রান্ত প্রস্তাব সারসংক্ষেপ আকারে প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরের জন্য পাঠাবেন। এটি ‘নীতিগত বিষয়’ হওয়ায় সরকারের রুলস অব বিজনেস-এর রুল ৪(২) অনুযায়ী তা অবশ্যই মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হতে হবে। তাই প্রধানমন্ত্রী সই করার পর এটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপনের জন্য কেবিনেট সচিবের কাছে দেবেন এবং কেবিনেট সচিব মন্ত্রিসভার বৈঠকে পেশ করবেন। মন্ত্রিসভা পাস করলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গেজেট প্রকাশ করবে ও কোটা পদ্ধতি বাতিল হবে। আমার মতো ক্ষুদ্র বিদ্যা-বুদ্ধির মানুষ যতটুকু বুঝি, কোটা বাতিল করে কোনও প্রজ্ঞাপন জারি হলে তা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হবে। সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না’। কিন্তু ২৮(৪) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘নারী ও শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না’। অন্যদিকে, সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদে সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতার কথা উল্লেখ করা হলেও ২৯(৩) ধারায় বলা হয়েছে, এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই - (ক) নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইবে’। সংবিধানের এ দুটি বিধানকে কার্যকর করতে কোটা পদ্ধতি চালু করে বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন সংবিধান সংশোধন না করে সকল কোটা বাতিল করা হলে তা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হবে বলেই প্রতীয়মান হয়। আর সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোনও আইন, বিধান, আদেশ বা প্রজ্ঞাপন চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করা হলে তা বাতিল হবে। ইতোমধ্যেই চাউর হয়েছে কোটা বাতিল করা হলে রিট মামলা দায়ের করার জন্য কোনও কোনও পক্ষ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন।
কোটা বাতিলে প্রধানমন্ত্রীর দুঃখভারাক্রান্ত ঘোষণা বাস্তবায়নে আইনগত জটিলতার আশঙ্কা থাকলেও টানেলের ওপারে আশার আলো রয়েছে। কোটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কেবল বাতিলের একক ও চূড়ান্ত ঘোষণা দেননি। তিনি বক্তব্যের মাঝে কোটা সংস্কারের বিষয়টিও জিইয়ে রেখেছেন এই বলে ‘…….সংস্কার করতে গেলে আরেক দল এসে বলবে আবার সংস্কার চাই। কোটা থাকলেই সংস্কার। আর কোটা না থাকলে সংস্কারের কোনো ঝামেলাই নাই। কাজেই কোটা পদ্ধতি থাকারই দরকার নাই। আর যদি দরকার হয় আমাদের কেবিনেট সেক্রেটারি তো আছেন। আমি তো তাকে বলেই দিয়েছি, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বসে তারা কাজ করবেন। সেটা তারা দেখবেন।……’
আমার পরামর্শ হলো, আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীকে আবেদন জানাক কোটা বাতিল নয়, কোটা সংস্কারের জন্য। প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই শেষে প্রজ্ঞাপন জারি করতে আবেদনে ৪০-৪৫ দিনের একটি সময়সীমা উল্লেখ করা যেতে পারে। কিংবা প্রধানমন্ত্রী নিজেই একটি কমিশন গঠন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংস্কারের প্রজ্ঞাপন জারির উদ্যোগে নিতে পারেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও নানা অবিমৃশ্যকারিতার পরিচয় দিয়েছেন। আর আন্দোলনকারীরাও চোরাগুপ্তা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েছে। এখন সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা। কোটা বাতিল নয়, সংস্কার হোক। সকল বিভ্রান্তি আর অবিমৃশ্যকারিতার অবসান হোক।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: zhossain@justice.com