ফারাক্কার লংমার্চ ও নদী ব্যবস্থাপনা

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীপণ্ডিতেরা বলে থাকেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে পানি নিয়ে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হোক বা না হোক এরই মাঝে আঞ্চলিক যুদ্ধ হতো ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টা অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে, যদি বাংলাদেশের শক্তি-সামর্থ্য ভারতের কাছাকাছি হতো। ভারত ৫৪টা অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে একতরফা এত খেলা খেলছে যে ৫৪টা নদীই অচিরে পানিশূন্য হয়ে যাবে।
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বুঝেছিলেন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করে পারা যাবে না। তাই তিনি বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করে ভারতকে নমনীয় করার পথে হেঁটে ছিলেন। এ কারণেই তিনি ১৯৭৬ সালে ১৬ মে ফারাক্কা লংমার্চের আয়োজন করেছিলেন। তখন তার বয়স ৯৬ বছর। লংমার্চের বয়স আজ ৪২ বছর। ১৫ মে তিনি রাজশাহীতে গণজমায়েত করলেন। ১৬ মে তিনি রাজশাহী থেকে চাঁপাইয়ের কানসাটের দিকে রওনা হলেন।
অভাবনীয় ব্যাপার ছিল মওলানাকে অনুসরণ করেছিল লক্ষ মানুষের জনসমুদ্র। অসুস্থ মওলানা একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে কানসাটে পৌঁছে ছিলেন। আর এক অভাবনীয় ব্যাপার ছিল স্থানীয় জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পদ্মা নদীর ওপর নৌকার পর নৌকা দিয়ে ব্রিজ তৈরি করে রেখেছিলেন যেন মওলানা নদী পার হয়ে ভারতের ভূমিতে পৌঁছাতে পারেন।

ভারতের সীমান্তে সেনা পাহারা মোতায়েন করেছিল ভারত আর মাইক দিয়ে সেনা অফিসাররা বারবার আহ্বান জানাচ্ছিল তিনি যেন মানুষ নিয়ে নদী অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করার চেষ্টা না করেন। মওলানা সীমানা অতিক্রম করেননি। সমাবেশে জ্বালাময়ী বক্তৃতা এবং ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি আল্টিমেটাম দিয়ে বক্তৃতা শেষ করেছিলেন। লংমার্চেরও পরিসমাপ্তি হয় সেখানে।

এর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে পানি চুক্তি হয় তাতে ভারত ৪০ হাজার সিউসেক পানি দিতে সম্মত হয় এবং ওই চুক্তিতে গ্রান্টি ক্লজও ছিল। সে বছরেই এ মহান দেশপ্রেমিক মওলানার জীবনাবসান হয়। সে থেকে এ পর্যন্ত আর কোনও নেতা উঠে আসেনি যারা পানি নিয়ে আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। অথচ ভারতের নদী ব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশে পানি ব্যবস্থাপনায় এমন এক করুণ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে বাংলাদেশের নদীগুলো পানির অভাবে বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। একে একে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

ভারত কর্তৃক বিভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। ফারাক্কা নির্মাণের আগে খুলনায় সর্বোচ্চ লবণাক্ততা ছিল ৫০০ মাইক্রোমোস। এখন ফারাক্কায় গঙ্গার প্রবাহ আটকে যাওয়ার ফলে খুলনায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৫০০ মাইক্রোমোস। লবণাক্ত পানি এখন গোপালগঞ্জ ও নড়াইল পর্যন্ত পৌঁছেছে। লবণাক্ত পানি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অবশ্য আশার কথা আমাদের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট লবণাক্ততা সহনীয় ধান বীজ উদ্ভাবন করতে পেরেছে। এবং এ ধানের পরীক্ষামূলক আবাদও হয়েছে বরগুনার চরাঞ্চলে। আমাদের গবেষণা বিজ্ঞানীদের আরো বহু বিষয়ে গবেষণা করে নতুন নতুন প্রজাতির ধান আবিষ্কার করতে হবে যাতে অধিক ফলন হয়। অবশ্য আমাদের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এ বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন। তিনি বিজ্ঞানীদের এ কথা বলে রেখেছেন লবণের হাঁড়িতে ধান উৎপাদন করতে হবে। যাক, বলছিলাম গঙ্গার কথা। ফারাক্কায় গঙ্গার পানি একতরফা প্রত্যাহারের ফলে বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের পাম্পগুলো চালানো দুরূহ হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে ফারাক্কার ফলে গঙ্গা অববাহিকার অনেক নদী মরে যাচ্ছে। উত্তরের এ নদীগুলো হচ্ছে মহানন্দা, পাগলা, শিব, বারনাই, ঘুমনি, বারল ও ইছামতি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলো হচ্ছে মাথাভাঙ্গা, গড়াই, ভৈরব, বেতনা, কোবাদাক, কোদালিয়া, মধুমতি, নবগঙ্গা, চিত্রা, কচুয়া, কুমার, আড়িয়াল খাঁ, বলেশ্বর, কেচা, পালং, তরাকি, রূপসা, বিশখালী, ভাদরা, শিবশা, চন্দনা, বেগবতী, লোহাদিয়া, তেঁতুলিয়া, ভোলা, খোলপেটুয়া, ইছামতি, কালিন্দি, সাতক্ষীরা, ধানসিঁড়ি, পশুর, শাহবাজপুর ও রায়মঙ্গল। এছাড়া প্রমত্তা পদ্মা ও যুমনাও শুকিয়ে যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগ সরকার ৩০ বছরের পানি চুক্তি করেছিল। তখন ভারতের কেন্দ্রে দেবগৌড়ার যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন ছিল। ফারাক্কা পয়েন্টে আগে পানি থাকতো ১ লক্ষ ৭০ হাজার কিউসেক আর এখন পানি থাকে ২৫ হাজার কিউসেক। ভাগাভাগি হলে বাংলাদেশ পানি পায় সাড়ে ১২ হাজার কিউসকে। ভারত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, দুধকুমার, ধরলা ও মহানন্দাসহ হিমালয় অঞ্চলে অভিন্ন নদী ও উপনদীতে ৫০০ বাঁধ নির্মাণ করেছে। দিন দিন বাংলাদেশের পক্ষে পানি পাওয়ার বিষয়টা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে।

যে ফারাক্কা চুক্তি দেবগৌড়ার সরকার আর শেখ হাসিনার সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল তাতে গঙ্গাবাঁধ নির্মাণের কথাও রয়েছে। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে তিস্তাবাঁধ অকার্যকর হয়ে রয়েছে অথচ তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনার জন্য তিস্তাবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৭০ মাইল উজানে গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে ভারত তিস্তার সব পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এখন ৫০০ কিউসেক পানিও পাওয়া যাচ্ছে না অথচ এক হাজার কিউসেকের কম পানি হলে নদীর নাব্য রক্ষা করা যায় না। এখন তিস্তাবাঁধও অকেজো আবার নদীতেও পানি নেই।

কৃষি ব্যবস্থা খুবই কঠিন বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। গঙ্গাবাঁধ নির্মাণ করলেও অনুরূপ অবস্থা হবে। কারণ, গঙ্গার উজানে আরো বহু বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত। এত বাঁধ অতিক্রম করে শুষ্ক মৌসুমে খুব অল্প পরিমাণ পানি আসবে বাংলাদেশে।

টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করার কথা বলছে ভারত। সিলেটের উজানে সুরমা-কুশিয়ারা বরাক নদীর সঙ্গে মিশেছে। সেই বরাক নদীর ১০০ কিলোমিটার উজানে মনিপুরের টিপাইমুখ নামক স্থানে ভারত বাঁধ নির্মাণ করছে। টিপাইমুখে ভারত পানি প্রত্যাহার করলে সুরমা, কুশিয়ারা, মেঘনা অববাহিকায়ও পানির অভাব হবে। ফলে বৃহত্তম কুমিল্লা ও বৃহত্তম সিলেটে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। অধিকন্তু এই বাঁধটি হবে দুটি টেকনোটিক প্লেটের সংযোগস্থলে, যে কারণে ভূমিকম্পের প্রবণতা বাড়বে। আর সত্যি সত্যিই যদি ভূমিকম্প হয় তবে বাঁধ ভেঙে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।
দীর্ঘ সময়ব্যাপী বাংলাদেশ সরকার পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে উদাসীন বলে মনে হচ্ছে। ভারত বাংলাদেশকে কখনও তার ন্যায্য হিস্যা দেবে না এ কথা মনে রেখেই এখন বাংলাদেশকে তার পানি ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা করতে হবে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ও দেশীয় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটা মিশন গঠন খুবই জরুরি। এবং মিশনের পরামর্শ অনুসারে পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে উদাসীন থাকলে শেষ পর্যন্ত দেশ বিপদের সম্মুখীন হবে।

মওলানা ছিলেন চিরপ্রতিবাদী মানুষ। কখনও ক্ষমতায় যাননি। আসাম রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। এই ছিল তার ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ। আসামে লাইন প্রথা আন্দোলন করে তিনি আসামে মুসলমানদের জন্য আসামের মাটিতে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদান রয়েছে। ফারাক্কা লংমার্চ করে তিনি পানি নিয়ে ভারত যে বাংলাদেশের সঙ্গে খেলছে সে বিষয়ে বিশ্ব বিবেককে সজাগ করেছিলেন। অনুরূপ মানবপ্রেমী মানুষ বিরল। আসাম-বাংলার বহু ঐতিহাসিক ঘটনার তিনিই ছিলেন অনুঘটক। ঘুরে ফিরে ইতিহাস তাকে স্মরণ করবে বারবার। তিনি মুকটহীন সম্রাট।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।

Bakhtiaruddinchowdhry@gmail.com