দুই রকম চুরির সঙ্গেই সংশ্লিষ্টতা আছে কেনাকাটার। কেনাকাটা মানেই কমিশন, কমিশন মানেই ভারি পকেট। ব্যক্তিগত বাজার সদাই বা দাফতরিক ক্রয়, সে সরকারি হোক বা বেসরকারি, সুযোগ থেকে যায় চুরির। কেউ সেই সুযোগ কাজে লাগায় কেউ লাগায় না হয়তো। সমাজের মান নামতে নামতে এখন এমন তলানিতে ঠেকেছে যে সুযোগসন্ধানী হলেই সে স্মার্ট, সম্মানীয়, পৃথিবী তার পায়ে লুটায়। কেনাকাটার ফাঁকফোকর দিয়ে চুরিচামারি হবে, এটা এখন প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে চলে গেছে। কেনাকাটার চুরি ঠেকাতে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কৌশল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সবখানেই যেন বজ্র আঁটুনি, ফস্কা গেরো। একটা আটকানোর সিস্টেম তো দশটা বের হওয়ার পথ। সোজা বাজারে গিয়ে কিনে আনলে চুরির সম্ভাবনা থাকে, সুতরাং করো টেন্ডার। যে জিনিসের দাম বাজারে ২০০ টাকা সে জিনিসের দাম টেন্ডারে আসে ৬১৯! নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীরা হাঁকে ৬২০, ৬২১, ৬২২। অতএব, ৬১৯ জয়যুক্ত হয়। কমপক্ষে ইউনিটপ্রতি ৪১৯ টাকা চলে যায় ক্রেতাদের পকেটে, সরাসরি। যে টাকাটা ছিল আমাদের শ্রম, ঘামের আয়ের বৃহত্তম অংশ, যা কিনা আমরা ট্যাক্স হিসেবে সরাসরি দেই। পরোক্ষভাবে প্রতিদিন প্রত্যেকটা লেনদেনে আমরা ট্যাক্স দেই। সেই টাকা সিস্টেমে চুরি হয়ে যায়, রাষ্ট্রীয় কেনাকাটায়।
দ্রব্য কিনুক বা সেবা কিনুক, লেনদেন হয় বড়। ভাগবাটোয়ারা হয় আরও বড়। চাল থেকে কম্বল, বাস থেকে প্লেন, ছুরি, চাকু থেকে মিগ, ফ্রিগেট, সাবমেরিন। ছাপাখানা থেকে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি। দোকানপাট থেকে টেলিভিশনের লাইসেন্স। দেশের উন্নয়নে বিদেশি পরামর্শ থেকে পদ্মা সেতুর নকশা অথবা সর্বাধুনিক কোনও প্রযুক্তি সবকিছুই কেনা হয়। কেনা হয় উচ্চদামে। আর কেনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, বদঅভ্যাস। ছোটকালে বাজারের টাকা সরানোর বদঅভ্যাস।
শুধু সরকারে নয়, আগেই বলেছি বেসরকারেও কত রকম পদ্ধতি। দশ টাকার জিনিসে ১০০ টাকার বিল ভাউচার। তার ওপর চারটা পাঁচটা সই সাবুদ এক্কেবারে পাক্কা বিল। কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট চলে। ঠেলতে ঠেলতে গলদঘর্ম। তার ফাঁকে ফাঁকে কেনার সুযোগ পেলেই চলে চুরি। ১৮ লাখ টাকার গাড়ি আসে, সঙ্গে আছে ৩০ লাখ টাকার বিল ভাউচার।
পরের পয়সায় কিছু কিনতে গেলেই যেন হাত নিশপিশ করে বাঙালির। সমাজের সকল স্তরে স্তরে এখন অন্যায়ের ঘুণ।
এসব এখন ওপেন সিক্রেট। সবাই জানেন। এটাই এখন আমাদের সংস্কৃতি। জানি বলেই, এখন আর কেনার গল্প শুনলে খুশি লাগে না। অশান্তি লাগে। মনে হয়, কত গেল! বিমান বহরে নতুন বিমান আসলে যেমন মনে হয়, গেল! পদ্মা সেতুর পাইলিংয়ের নকশায় ভুল থাকায় আবার পরিবর্তন করতে হবে শুনলেও মনে হয়, গেল! যা কিছু নতুন, যা কিছু ক্রয়, সাথে চুরি হয়ে যাওয়ার আফসোস। আরো আফসোস, এতে এখন আর কারো কিছু যায় আসে না। সবাই যেন অভ্যস্ত এ নিয়মে।
আর অভ্যস্ত বলেই হয়তো পরিবর্তনের কোনও লক্ষণ নেই। উন্নয়ন মানে আমরা এখন বুঝি অবকাঠামোর উন্নয়ন। যে উন্নয়ন চুরির সুযোগ দেয়। অথচ সত্যিকারের গুণগত উন্নয়ন হতো যদি কিনা, সমাজে এই ধারণাটা পাল্টে ফেলা যেত। এমন ব্যবস্থা তৈরি হতো, যে ব্যবস্থায় কেউ চুরি করবে না, কমিশন নিবে না। কেনা মানে শুধুই ন্যায্যমূল্য। ট্যাক্স দিয়ে নিশ্চিত থাকা যেত। জানতাম, কোনও ব্যক্তির দেশি-বিদেশি পকেট ভারি হবে না এই টাকায়। তখন রাষ্ট্রীয় কোনও বৃহৎ কেনাকাটাতেও খুশি হওয়া যেত শতভাগ। এখন যেখানে খুশির সাথেও মিশে থাকে সংশয়।
এমন দিন কবে আসবে?
লেখক: উন্নয়নকর্মী