অন্যদিকে সরকারের বাইরে থাকা বড় রাজনৈতিক দলটি জেল-জুলুমেই দিশাহারা। তাদের সরকার বিরোধিতা জেলক্লিষ্ট, মামলাপুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারাই তাড়িত। ফলে বাজেট নিয়ে তারা যা বলে তার মধ্যে থাকে রাজনৈতিক বিদ্বেষ। বাজেটের জনবিচার করা তাদের দ্বারা আর সম্ভব হয় না।
বাম সংগঠনগুলোর মধ্যে যারা আওয়াজে, কর্মিসংখ্যায় বড় তাদেরও একটা নীরব আত্মাহুতি ঘটেছে সরকারি দলের ভাবনায়। তারা সরকার বিরক্ত হয় এরকম কোনও কর্মসূচি নেওয়ার বদলে ইফতার পার্টিতে বসে গালগপ্প করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বেশি। ফলে বাজেট নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা এখন কম।
রাজনৈতিক দলগুলোর অনুপস্থিতিতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডিই গত কয়েক বছর ধরে বাজেটের একাডেমিক সমালোচনা করে। এবং এ কারণেই তারা সরকারের গা জ্বালার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিপিডি একটা এনজিও, ফলে তার সামর্থ্যেরও সীমাবদ্ধতা আছে। তাই বাজেট ঘোষণার পর সরকারের রাজনৈতিক সমালোচনা করে বাজেট নিয়ে আলোচনা আর হয় না। সে কারণে আত্মঅহমিকায় ভোগা সরকারের দিক থেকে সমালোচকদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার একটা প্রবণতাও দেখা যায়।
২.
বাজেট নিয়ে সরকারের আত্মঅহমিকার একটা বড় কারণ, সরকার ক্রমান্বয়ে দেশের সবচেয়ে বড় বাজেট দিয়ে চলেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবারও সরকার দেশের সর্ববৃহৎ আকারের বাজেট দিয়েছে। সরকারের প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট হচ্ছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫শ’ ৭৩ কোটি টাকার। এরমধ্যে আয় হবে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৩শ’ ৩১ কোটি টাকা। বাজেটে ঘাটতি থাকবে ১ লাখ ২১ হাজার ২শ’ ৪২ কোটি টাকা। এই ঘাটতির অংকও সর্ববৃহৎ। ঘাটতির পরিমাণ প্রস্তাবিত বাজেটের ২৬.০৯% ।
এই বড় অংকের ঘাটতি মিটবে কীভাবে? সরকার বলছে ব্যাংক থেকে ঋণ, বিদেশি ঋণ আর ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ থেকেই এই ঘাটতি মেটাবে। ব্যাপারটা অনেকটা ‘ঋণ করে ঘি খাওয়া’র মতোই। ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তার চাপ পড়বে দেশের ব্যাংকিং খাতে, অর্থনীতিতে। সেটা কিছু মানুষের পুষ্টি ঘটালেও আমজনতার জন্য কষ্ট আনবে।
সরকার তার প্রস্তাবিত বাজেটে যে বড় আয়ের ঘোষণা দিয়েছে, তা আসবে কোথা থেকে? এর একটা বড় অংশ আসবে ভ্যাট আর আয়কর থেকে। প্রায় ৬৬ শতাংশ আয় আসবে জনগণের ভ্যাট আর করের টাকায়। সুতরাং বোঝা যায় ভ্যাটের পরিধি ও পরিমাণ দুটোই বাড়বে। সেটা সমাজের টাকাওয়ালাদের কষ্ট না দিলেও সমাজের মধ্যবিত্ত আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সুখকর হবে না।
তবে এই বাজেটের বড় সাফল্য, সরকারের কাজের একটা ধারাবাহিকতা এই বাজেটে আছে।
সমালোচনা হচ্ছে এই বাজেট মধ্যবিত্তদের কষ্ট বাড়াবে। পুষ্ট করবে ধনী ও নব্য ধনীদের। সরকার অবশ্য এই সমালোচনা গায়ে মাখতে রাজি নয়। সরকারের এক-দশকের কাজ দেখলে বোঝা যায়, সরকার সব সময় চাইছে একশ্রেণির পয়সাওয়ালা সমাজে তৈরি হোক। সরকারি আনুকূল্যে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে একশ্রেণির ধনিক তৈরি হলে আখেরে তা সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলটির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আর্থিক ক্ষমতাকেই বাড়াবে। ধনতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থায় পৃথিবীর অনেক দেশেই এই দর্শনেই সরকার তার রাজকাজ চালায়। এই সরকারও তার ব্যতিক্রম নয়।
সরকার জানে এই ব্যবস্থায় দেশের সিংহভাগ সম্পদ গুটিকতক মানুষের হাতে চলে যায়। আর অধিকসংখ্যক মানুষ আরও কম সম্পদের মালিক হতে থাকে। সে কারণেই সরকার সামাজিক সুরক্ষা খাতে ভর্তুকি বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে এই দুষ্টক্ষত ঢাকা দিতে চায়। এবারের বাজেটেও তার প্রভাব সুস্পষ্ট।
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার শুধু ব্যাংক ও আর্থিক খাতের জন্য করপোরেট কর হার আড়াই শতাংশ কমানোর কথা বলেছে। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর হার ৪০ শতাংশ থেকে কমে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ হবে। এছাড়া শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর হার ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে ৪০ শতাংশ হবে।
উল্লেখ্য, ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাট নিয়ে সরকার লুটেরাদের বিরুদ্ধে কোনও বড় চাপ তৈরি করেনি। বরং লুটপাটকারীদের অতীতে প্রশ্রয়ই দিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকারদের চাপে আইন পরিবর্তন করেছে। বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের নানান সুবিধা দিয়েছে। ব্যাংক পরিচালকরা যা চাইছে তাই দিতে কখনও কুণ্ঠাবোধ করেনি সরকার। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো থেকে যে টাকা আত্মসাৎ হয়েছে, সেই পরিমাণ টাকা সরকারি খাত থেকে পূরণ করা হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং জনতা ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারিতে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সরকার খুব উৎসাহী হয়েছে এরকম নজির দেখা যায়নি। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটেও সেই ধারাই বহমান আছে।
৩.
সরকার যেমন ধারাবাহিকভাবে বড় বাজেটের ঐতিহ্য রক্ষা করছে তেমনি অর্থমন্ত্রীও রেকর্ড সৃষ্টি করছেন। ১২তম বার বাজেট পেশ করে তিনি উচ্চবিত্তদের তুষ্টির পথকে সুগম করে মধ্যবিত্তের ওপর চাপ সৃষ্টির ধারাবাহিকতা এবারও বজায় রেখেছেন। নীতি-নৈতিকতা আর মূল্যবোধ বিবেচনায় বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজ যেমন চাপের মধ্যে আছে, সরকারের এই বাজেট অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্তকে তেমনি চাপের মধ্যেই ফেলেছে। বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, যাতায়াতসহ মধ্যবিত্তের সকল ব্যয়ে কর, ভ্যাট, শুল্ক, নানা সারচার্জ এত পরিব্যাপ্ত হয়েছে যে এক কঠিন চাপের মধ্যেই পড়তে হবে এবার মধ্যবিত্তকে। এবারের বাজেট বড়লোকদের একটা বড় অংশকে পুষ্ট করবে বটে তবে চিড়াচ্যাপ্টা হবে মধ্যবিত্ত। বাজেটের এই অভিঘাত সমাজকে নানাভাবেই ভোগাবে। সিপিডির দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের অভিমত হচ্ছে, ‘যার পুঁজি ও সম্পদ আছে তার আয় বাড়ানোর সুযোগ আছে। কিন্তু শ্রম ও উদ্যোগের মূল্য নেই। ধনী-গরিবের বৈষম্যও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আগের চেয়ে বেড়েছে। বৈষম্য বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ যেন পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ভাগ হয়ে গেছে। পূর্বদিকে আছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটের মতো ধনী অঞ্চল। আর পশ্চিম দিকে আছে বরিশাল, খুলনা ও রাজশাহীর মতো দরিদ্র অঞ্চল।’
অর্থমন্ত্রী রাজনীতির মানুষ না। তিনি অভিজাত আমলাতন্ত্র থেকে রাজনীতির উপরিকাঠামোয় বসবাস করা মানুষ। তিনি সমাজ অভিঘাতের এই পরম্পরার রাজনীতি কতটা আমলে নেন সেটা একটা প্রশ্ন। কাজেই অর্থনীতির কারণে জনগণের মধ্যে যে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে এবং সেটা যে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য কত বড় বিপদ ডাকতে পারে, সেটা অর্থমন্ত্রীর বুঝতে কতটা সক্ষম সেটাও বিবেচ্য বিষয়।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘যারা নির্বোধ ও যাদের দেশপ্রেম নেই, তারাই বাজেটকে ভুয়া বলে। ভুয়া বাজেট বলে কিছু নেই। বাজেট যখন দেই, সেটা ভেবেই দেই। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা যা নির্ধারণ করেছি, তা বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে করি।’
৪.
বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। প্রকল্পের উচ্চব্যয়, অতিব্যয়, প্রকল্পের টাকা নয়-ছয়, দুর্নীতি আমাদের জাতীয় রোগ। এই রোগ সারিয়ে বাজেট বাস্তবায়নে সক্ষমতা দেখিয়ে প্রকৃত জনকল্যাণ করা খুব সহজ কাজ নয়। এর জন্য দরকার নীতিনিষ্ঠ, সুশাসন নির্ভর প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব। সেটা যতদিন আমরা না পাচ্ছি ততদিন বাজেট যতই বড় হোক তা কিছু ছোট জটলার মানুষের ভাগ্য ফেরাবে বটে কিন্তু আমজনতার জন্য প্রকৃত তুষ্টি আনবে না। বড় বাজেট তাই অল্প কিছু ক্ষমতাবানের পুষ্টি ঘটাবে, তুষ্টিও আনবে। আমজনতার ভাগ্যের আর সত্যিকারের কোনও পরিবর্তন আসবে না।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক