সাম্প্রতিক বিশ্বব্যবস্থায় ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন জাতিসত্তা, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ধর্ম, এবং ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের প্রতি পৃথিবীর দেশে দেশে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা এবং ক্রমবর্ধমান হারে অপশ্চিমা দেশগুলোতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিজে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য করছে। ফলে, শরণার্থী সমস্যা একটি অন্যতম আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসাবে হালের পৃথিবীতে হাজির হয়েছে। জাতিসংঘের এক হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মিনিটে পৃথিবীতে ২০ জন লোক নিজের দেশ ত্যাগ করছে প্রধানতন যুদ্ধ, অত্যাচার, এবং নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য। দেশত্যাগী এসব মানুষ বিশ্বব্যাপী নানান নামে পরিচিত, যেমন: শরণার্থী (Refugee), আশ্রয়প্রার্থী (Asylum seekers), রাষ্ট্রবিহীন মানুষ (Stateless people), অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষ (Internally displaced people) কিংবা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষ (Forcibly displaced people)। গত ১৯/০৬/২০১৮ তারিখে দেওয়া জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী পৃথিবীতে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা আজ প্রায় ৬ কোটি ৮৫ লাখ, যা গত এক দশকে প্রায় দ্বিগুণ আকার ধারণ করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গোতেরেস ২০১৮ সালের 'বিশ্ব শরণার্থী দিবস' উপলক্ষে প্রদত্ত এক বাণীতে বলেছেন, 'পৃথিবীতে আজ প্রায় ৬৮ মিলিয়নের অধিক (৬ কোটি ৮০ লক্ষেরও অধিক) মানুষ অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু, যারা অন্য দেশে শরণার্থী হিসাবে জীবনযাপন করছেন, যা জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর ২০তম জনসংখ্যা-বহুল দেশটির সমান।' জাতিসংঘ মহাসচিবের বক্তব্য অনুযায়ী, 'গত বছর প্রতি সেকেন্ডে ২ জন লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে'। সুতরাং তার ভাষ্যানুযায়ী 'আজ আমাদের সকলের দায়িত্ব হচ্ছে এসব শরণার্থী এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের একটা মানুষের মতো জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা।' এখানে লেখা বাহুল্য যে কী কী কারণে এসব মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, এবং কোন কোন রাষ্ট্র স্বেচ্ছাচারীভাবে ভিন্ন জাতিসত্তার, ভিন্ন ভাষার, ভিন্ন ধর্মের, এবং ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে বাস্তুচ্যুত করছে, জাতিসংঘ সেটাকে যথাযথভাবে ‘এড্রেস’ করার জন্য কার্যকর কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করে না। কিংবা ইঙ্গ-মার্কিন নের্তৃত্বাধীন বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে কিংবা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তেল-গ্যাসের মজুদ দখলদারিত্বের সশস্ত্র প্রতিযোগিতায় হাজার হাজার মানুষ যে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, সেসব বিষয় নিয়ে জাতিসংঘের কার্যকর কোনও ভূমিকা আমরা দেখি না, যতটা শরণার্থীদের জন্য দরদ দেখি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনা চেয়ে চেয়ে দেখা, আর ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেলে, ছাই নিয়ে বিলাপ করা এবং নতুন ঘর তৈরি করার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন করাই হচ্ছে জাতিসংঘের কাজ। আগুন দেওয়া বন্ধ করতে, আগুনদাতাকে আগুন দেওয়া থেকে বিরত রাখতে কিংবা আগুন যখন জ্বলছে তখন আগুন নেভাতে জাতিসংঘের কোনও কার্যকর ভূমিকা আমরা দেখি না। তাই, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বিশ্বব্যাপী শরণার্থীর সংখ্যার এই ক্রমবর্ধমান অবস্থার পেছনের জাতিসংঘের ভূমিকাও কম নয়। আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবসে সেটাও আমাদের মনে রাখা জরুরি।
বাংলাদেশে বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালন সীমাবদ্ধ থাকে সংবাদপত্রের এক কলাম নিউজ হিসাবে, প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের একটা দেড় মিনিটের নিউজ আইটেম হিসাবে, এবং অদৃশ্যমান কিছু সরকারি রুটিনমাফিক নড়াচড়ার (রিচুয়ালিস্টিক মুভমেন্ট) মধ্যে। অথচ ১৯৭১ সালের পর থেকে বাংলাদেশে ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ নামে একটা বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া, ক্যাম্প করে তাদের থাকার বিশেষ ব্যবস্থা করা, তাদের দেখভাল করা, কিংবা পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো প্রভৃতি নানান বিষয় নানান সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে। ঢাকার মোহাম্মদপুর ও জেনেভা ক্যাম্পে এখনও পর্যন্ত হাজার হাজার ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ শরণার্থীদের বাংলাদেশ সরকারকে ডিল করতে হচ্ছে। ২০০৩ সালের এক হিসাবে অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ২ লক্ষ ৭৫ হাজার 'আটকে পড়া পাকিস্তানি' শরণার্থী ছিল, যা বর্তমানে প্রায় প্রায় ৫ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। তাছাড়াও ২০০৩ সালে মাননীয় হাইকোর্টের এক নির্দেশে এসব উর্দভাষী আটকে পড়া পাকিস্তানিদের একটা বড় অংশকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিতে হয়েছিল, বিশেষ করে যারা ১৯৭১-এর পরে জন্ম নিয়েছিল। আর এদিকে ১৯৭৮ সাল থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশে তৎকালীন বার্মা এবং বর্তমান মিয়ানমার থেকে আসা লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। ২০১৭ সালে নতুন করে আসা প্রায় ৭ লক্ষসহ বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করছে। অথচ, স্বাধীনতার প্রায় ৪৭ বছরও বাংলাদেশে শরণার্থী ব্যবস্থাপনার কোনও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নাই, কোনও শরণার্থী আইন নাই, এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সুনির্দিষ্ট কোনও দিকনির্দেশনা নাই। বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত 'শরণার্থী সনদে' এখন পর্যন্ত অনুস্বাক্ষর করেনি। ফলে, শরণার্থী ব্যবস্থাপনাকে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ‘ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা’র বিষয় হিসাবে বিবেচনা করে, যা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, দুর্যোগ এক জিনিস, কিন্তু শরণার্থী সমস্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কেন বাংলাদেশে কোনও 'শরণার্থী বিষয়ক নীতিমালা বা আইন নাই' তা নিয়ে মাননীয় হাইকোর্টে একজন আইনজীবী ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখ একটি রিট আবেদন করেন কিন্তু তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত কোনও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করেছে কিনা আমাদের জানা নাই। আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবসে আমাদের তরফ থেকে প্রথম দাবি হবে, বাংলাদেশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি 'শরণাথী বিষয়ক নীতিমালা' প্রণয়ন করবে আর সরকারের তরফ থেকে করণীয় হবে জরুরি ভিত্তিতে একটি 'শরণার্থী বিষয় নীতিমালা' তৈরিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বিশ্ব শরণার্থী দিবসে আজ বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের নাম জোরেশোরে আলোচিত হবে মূলত রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে। কেননা, রোহিঙ্গা সমস্যাকে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয় হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে এ নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য নাই, কিন্তু থাকাটা জরুরি ছিল। বরং আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে 'রোহিঙ্গা সমস্যা' নিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে একটি পরিষ্কার বার্তা পৌঁছে দেওয়া যেত। রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থা, তাদের নিয়ে বাংলাদেশ সরকার কী কী ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করছে, মিয়ানমার কীভাবে তাদের বাস্তুচ্যুত করেছে, মিয়ানমার কীভাবে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ করেছে, প্রত্যাবাসনের নামে মিয়ানমার কীভাবে বারবার কথার বরখেলাপ করছে, এবং ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের পরিকল্পনা কী প্রভৃতি বিষয়াদি বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর কাছে জানান দিতে পারত। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিভিন্ন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতদেরও আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে একটি পরিষ্কার ধারণা দিতে পারত, যা অত্যন্ত জরুরি ছিল। যেহেতু রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন, রাশিয়া এবং ভারত ছাড়া গোটা পৃথিবী বাংলাদেশের সঙ্গে আছে, বাংলাদেশের দায়িত্ব হচ্ছে এ সমর্থন, সহমর্মিতা এবং সহযোগিতার মনোভাবকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো, যাতে করে বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষমতা-ঘরের (পাওয়ার হাউজের) নানামুখী ভূ-রাজনৈতিক ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের যাঁতাকলে পড়ে রোহিঙ্গা সমস্যা গুরুত্ব হারিয়ে না-ফেলে। রোহিঙ্গা সমস্যাকে সময় ও সুযোগমত যতবেশি সম্ভব বাংলাদেশকেই বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করতে হবে। কেননা, রোহিঙ্গা সমস্যার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী (ভিক্টিম) হচ্ছে বাংলাদেশ। মনে রাখতে হবে, 'যার সমস্যা তার হুঁশ নাই, পাড়াপড়শির ঘুম নাই' এ-প্রবাদ একবিংশ শতাব্দীর এ-বিশ্বায়নের যুগে অচল। এখন যার সমস্যা তারই হুঁশ থাকতে হবে, এবং পাড়াপড়শির ঘুম ভাঙানোর দায়িত্বও তাকেই নিতে হবে।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।