গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাসাংবাদিকতায় পড়েছি, সাংবাদিকতা করি এবং পড়াই। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে ততই যেন মনে হচ্ছে অদ্ভুত সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি আমরা। কারও কিছু লেখা বা বলা হলেই বিভিন্ন শক্তি সাংবাদিকদের শত্রু ভাবতে শুরু করছে। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই। অপরাধ জগৎ, জঙ্গি গোষ্ঠী যেভাবে আক্রোশ মেটায় সেভাবে না হলেও রাজনীতি, করপোরেট, এমনকি সংস্কৃতির অঙ্গনও পিছিয়ে থাকে না সাংবাদিকদের আক্রমণ করতে। এই আক্রমণ শুধু শারীরিক নয়, সামাজিক মাধ্যমে অসামাজিক আঘাত বা প্রভাব বিস্তার করে পেশা থেকে সরিয়ে দেওয়া। সাংবাদিকদের দমন-পীড়ন, লাঞ্ছনা ও অত্যাচারের শিকার হওয়ার ঘটনা প্রতিদিন বাড়ছে। কিছু সামনে এলে প্রতিবাদ হয়, প্রতিকার হয় খুব কম। কিছু ঘটনা চাপা পড়ে যায়।
পাকিস্তান আমলে থেকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সাংবাদিকতাকে নানাভাবে আঘাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞা, জহুর হোসেন চৌধুরী, আবদুস সালামের মতো সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানকে খুব কমই পেরেছে নীতি থেকে, সত্য থেকে সরিয়ে রাখতে। এরশাদ জামানায় একের পর এক সংবাদপত্র বন্ধ হয়েছে, কিন্তু সাংবাদিকদের লড়াই থেমে যায়নি। লড়াই আজও থামেনি। কিন্তু আঘাত বেড়েছে।

দেশ স্বাধীনের সঙ্গে একটি শক্তিশালী স্বাধীন গণমাধ্যম জগৎ আমাদের অনেক দিনের চাওয়া। এই চাওয়া আজও পূরণ হয়নি, বরং গণমাধ্যম ও সাংবাদিকের স্বাধীনতা খর্ব হতেই দেখে আসছি। স্থানে স্থানে, বিশেষ করে রাজধানীর বাইরে নিয়মিত শুনতে পাই সাংবাদিকদের কপালে জুটছে গলাধাক্কা, মার ও লাঞ্ছনা। অনেক অফিসেই কড়াকড়ি সাংবাদিকদের প্রবেশে। সংবাদমাধ্যম আক্রান্ত এবং এই আক্রমণ বাড়ছে বই কমছে না।

একটা ভুল ধারণা হতে পারে যে শুধু ক্ষমতায় থাকা দল ও তার প্রশাসন এই আঘাত করে। তা নয়। যারা ক্ষমতায় আসতে চায় তারা করে, তারা হুমকিও দেয়। রাজনৈতিক কারণে কোনও কোনও মাধ্যম বর্জন করাও আঘাত। সেটি করে বিরোধী দলে থাকা দল ও ব্যক্তি, ধর্মীয় সংগঠনের নেতারা, এমনকি সুশীল বলে পরিচিতরাও ।

আজ চব্বিশ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেলের রমরমা। পুরো বদলে গিয়েছে গণমাধ্যমের চেহারা। যেকোনও অনুষ্ঠানে বা ঘটনায় উপস্থিত হলেই দেখা যায় সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানদের ভিড়। গণমাধ্যমের এই পরিধির বিস্তার সত্ত্বেও, মিডিয়া আগের চেয়ে শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও প্রাণহারা মনে হয় এই পেশাকে। চাকরির নিরাপত্তা নেই, ভালো ও নিয়মিত বেতন নেই। অন্যান্য খাতের মতো সুবিধা নেই।

চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকতে খুলনাসহ সারা দেশের নানা প্রান্তে মানিক সাহা, হুমায়ুন কবীর বালু, হারুনুর রশীদ, বেলালসহ একের পর এক সাংবাদিক খুন হন। এক ভয়ের পরিবেশ ছিল পুরো সময়টা। এরপর শুরু হয়েছিল ধর্মীয় উগ্রবাদীদের কর্তৃক লেখক, প্রকাশক হত্যা। 

গত এপ্রিলে একটি খবর প্রকাশিত হয়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৪৬ নম্বরে। সূচক দিয়ে গণমাধ্যমের বা এর কর্মীদের অবস্থাকে বিচার করা যায় না সবসময়। বাংলাদেশে শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাংবাদিকরা নানাভাবে সক্রিয় সাংবাদিকতা করছেন। টেলিভিশন টকশোতে অবাধে সরকারের সমালোচনা, বিরোধী দলের আলোচনা, সমালোচনা চলছে। পত্রিকায়, অনলাইনেও চলছে তারস্বরে।

আমরা গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে সরকার বা রাষ্ট্রকে নিয়ে যত কথা বলি, তারচেয়ে অনেক কম বলি করপোরেটের চাপ, লেখক-শিল্পীদের কট্টর মতামত, মিডিয়ার আপস নিয়ে। গণতন্ত্রের পক্ষে এগুলোও বড় সমস্যা। মত প্রকাশের স্বাধীনতার বাধা হচ্ছে ঔপনিবেশিক আইন, বিচার ব্যবস্থার ত্রুটি এবং পরিচিতির রাজনীতির দাপট। এগুলো অনেক থেকেই সমস্যা।

কয়েকটা খুব বড় বাণিজ্যিক সংস্থা বাড়াবাড়ি রকমভাবে বিজ্ঞাপন দুনিয়াটা অধিকার করে রেখেছে। এর ফলে তারা কাগজ ও টেলিভিশন চ্যানেলের ওপর অতিরিক্ত চাপ দিতে পারে। অনেক সময় চাপের কাছে তাড়াতাড়ি নতজানু হয়েও যায়। এই দুদিক থেকেই মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিপদ বেশি।

বড় বিপদটি হলো গুণ্ডা-বদমাশ বা ধর্মান্ধরা লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানো লোক পাওয়া যাচ্ছে আজকাল খুব কম। রাজনীতিকরা কোনও ঝুঁকি নিতে নারাজ। আর রাজনীতি সমর্থিত পেশাজীবীদেরও বিশেষ কোনও মাথাব্যথা দেখা যায় না এসব ক্ষেত্রে। যারা নিজেদের উদ্যোগে সাংবাদিকতা করেন, তাদের ক্ষেত্রে এই বিপদ অতি প্রবল, বিশেষত দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে, কারণ জাতীয় সংবাদমাধ্যমের নাগাল ও নজর থেকে তারা অনেক দূরে।

বর্তমান বাস্তবতায় বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের জন্য সমস্যাগুলো হলো– গণমাধ্যমের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, সরকার ও জাতীয় সমস্যা এবং আন্তর্জাতিকভাবে তৈরি হওয়া উগ্রবাদ, বর্ণবাদ ও ধর্মান্ধতা। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথা বলে সাম্প্রদায়িক নানা ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। কিন্তু ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার জন্য সেখানে গণমাধ্যমগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। যারা সাংবাদিকদের আঘাত করেন, দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চান, তারা বুঝবেন না কোনোদিন যে শেষ কথা বলে মানুষই এবং সাংবাদিকরা সেই সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি। অসম্মান আর দমন-পীড়ন সহ্য করেও সাংবাদিকতার উজ্জ্বল নিশানকে তুলে ধরতে উদ্বুদ্ধ হবে আগামী দিনে। কারণ, সৎ ও আপসহীন সাংবাদিকতার মৃত্যু নেই। সাময়িকভাবে কারও কলম থামানো গেলেও সত্যকে প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা করার নেশা যুগ যুগ ধরে চলতেই থাকবে।

লেখক: এডিটর-ইন-চিফ, জিটিভি ও সারাবাংলা