দুনিয়া কাঁপানো করমর্দন

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীগত ১২ জুন সিঙ্গাপুরে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের মাঝে একদিনের এক ঐতিহাসিক বৈঠক হয়েছে। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমেরিকার কোনও প্রেসিডেন্টের এটাই গত ৭০ বছরের মাঝে প্রথম বৈঠক। গত এক বছরব্যাপী কোরীয় উপদ্বীপ ট্রাম্প ও উনের হুমকি, পাল্টা হুমকিতে উত্তপ্ত ছিল। বিশ্ববাসীও উদ্বেগের মাঝে ছিল কারণ উভয় রাষ্ট্র আণবিক অস্ত্রের অধিকারী, আবার উভয় নেতা হঠকারীও। এই প্রেক্ষাপটে গত ১২ জুনের সিঙ্গাপুরের বৈঠক উদ্বেগ নিরসন এবং শান্তি স্থাপনের পথে বিরাট এক অগ্রগতি।

কিমের কাছে ট্রাম্পের প্রত্যাশা ছিল সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ এবং ট্রাম্পের কাছে কিমের চাওয়া ছিল বাণিজ্য অবরোধ প্রত্যাহার। দেড় পৃষ্ঠার একটা দলিল উভয় পক্ষ দস্তখত করেছেন। দলিলটা অসম্পূর্ণ, অস্পষ্টতায় ভরা। দলিলে বলা হয়েছে ‘কোরীয় উপদ্বীপকে পরিপূর্ণভাবে পরমাণু-নিরস্ত্রীকরণের কাজ এগিয়ে নিতে উত্তর কোরিয়া প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।’

একটা নিরস্ত্রীকরণের চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে মন্ত্রী পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা হতে হয়। ইরানের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের আগে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন ফ্রান্স ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের পর বৈঠক হয়েছে। কিন্তু গত ১২ জুনের বৈঠকটা হলো কোনও পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই। অথচ উত্তর কোরিয়া হচ্ছে পরিপূর্ণভাবে একটা আণবিক অস্ত্রের অধিকারী দেশ। তার নিরস্ত্রীকরণটা খুব সহজ বিষয় নয়।

বিশেষ করে গত ২৭ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ার পানমুনজমে উভয় কোরিয়ার প্রেসিডেন্টদ্বয়ের বৈঠকের পর যে ঘোষণা প্রদান করা হয় সে ঘোষণায় উত্তর কোরিয়া বলেছে তারা কোরিয়া উপদ্বীপের পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ কার্যক্রমকে বৈশ্বিক পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের অংশ হিসেবে দেখতে চায়। এ কথার অর্থ দাঁড়ায় আমেরিকা, রাশিয়া, চীনসহ অন্যান্য পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী দেশ পরমাণু অস্ত্র ত্যাগ করলেই উত্তর কোরিয়া তার কার্যক্রম বন্ধ করে দেবে। ১২ জুনের ঘোষণাও প্রায় অনুরূপ, অর্থাৎ ‘নিরস্ত্রীকরণের কাজ এগিয়ে নিতে উত্তর কোরিয়া প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।’

বৈঠকের পরই আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিউলে গেছেন। সিউলে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি বৈঠক করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে পাম্পেও বলেছেন, সম্পূর্ণ পরমাণু অস্ত্রমুক্ত হওয়ার প্রমাণ দেখানো ছাড়া উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে বাণিজ্য অবরোধ প্রত্যাহার করা হবে না। এ কথা আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাম্পেও বলার পর মনে হচ্ছে যে আমেরিকা নিরস্ত্রীকরণের ব্যাপারে আন্তরিক নন।

শুধু দক্ষিণ কোরিয়ায় আমেরিকা তার যৌথ মহড়া সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেবে- এ আশ্বাসের ওপর উত্তর কোরিয়া সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ করতে যাবে বলে মনে হয় না। কারণ, দক্ষিণ কোরিয়ায় আমেরিকার ৩২ হাজার সেনা সদস্য রয়েছে। জাপানেও আমেরিকার সেনাবাহিনী রয়েছে আর গয়ম কোরিয়ার নিকটবর্তী আমেরিকান ঘাঁটি। আমরা বুঝেছি যে কিম জং উন নিরস্ত্রীকরণের ব্যাপারে আন্তরিক। কারণ, বৈঠকের ৫ দিন আগে কিম জং উন উত্তর কোরিয়ার একটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ক্ষেত্র সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ধ্বংস করে দিয়েছেন। হয়তো এটা তার সৎ ইচ্ছার নিদর্শন দেখানোর উছিলা ছিল। যাতে সৎ ইচ্ছার আবহের মাঝে আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে পারে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় যে যৌথ মহড়া হয় তাতে গয়ম ঘাঁটির শক্তিশালী আমেরিকান সেনাবাহিনী এবং বিভিন্ন প্রকারের ওয়্যার হার্ডওয়ার সমবেত করা হয়। এবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্বীকার করেছেন এই মহড়া আসলে উত্তর কোরিয়ার জন্য ভয়ভীতি সৃষ্টি করে, তদুপরি এই মহড়া খুবই ব্যয়বহুল। ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার ভয়ভীতি সৃষ্টির অভিযোগ বহুদিন পরে স্বীকার করে নিলেন। তিনি আরও বলেছেন, গাদা গাদা ডলার খরচ করে উত্তর কোরিয়াকে শুধু শুধু উত্ত্যক্ত করার কোনও মানে হয় না।

অবশ্য মহড়া বন্ধ করলেই সমস্যা সমাধানের পথ উন্মুক্ত হয়ে গেলো তা নয়। ১৯৯২ সালে বুশ সিনিয়রও মহড়া একবার বন্ধ করেছিলেন। আবার বিল ক্লিনটন ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মহড়া বন্ধ করে রেখেছিলেন, কিন্তু নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে কোনও গঠনমূলক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। অবশ্য তখন চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়া কোনও ভূমিকায় ছিল না। এখন চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়া সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

গত ২৭ মে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন পানমুনজনে কিম জং উনের সঙ্গে যে বৈঠক করেছিলেন সে বৈঠকই তো সিঙ্গাপুর বৈঠকের দ্বার উন্মোচন করেছে। সিঙ্গাপুরের শীর্ষ বৈঠকের জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল। ট্রাম্প সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়ও উল্লেখ করেছেন।

আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দাভাব কাটানোর জন্য ট্রাম্প ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করার পক্ষে। সুতরাং ট্রাম্প ব্যয় সংকোচন করার প্রয়োজনে হয়তো অনেক কিছু করতে সম্মত হতেও পারেন। তবে চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়া এ বিষয়ে লাগাতার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ট্রাম্প নিজেই উপলব্ধি করেছেন এক বৈঠকে এ সমস্যার সমাধান হবে না। বারবার বৈঠকের বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়াকে দূতিয়ালির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।

আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও বলেছেন, পরিপূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের প্রমাণ ছাড়া আমেরিকা বাণিজ্যের ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করবে না। উত্তর কোরিয়ার এখন খাদ্য ও জ্বালানির প্রয়োজন খুব বেশি। দুইটা জিনিসই অতীব প্রয়োজনীয়। সুতরাং এ দুই বিষয়ে উত্তর কোরিয়াকে ছাড় না দিলে হয়তো শুরু হওয়া আলোচনা পুনরায় বন্ধ হয়ে যাবে। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন বর্তমানে চীন সফরে রয়েছেন। তার সফর শেষে হয়তোবা আমরা উভয়ের প্রতিক্রিয়া পাবো।

১৭ জুন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীও চীন সফরে গেছেন। সুতরাং কেউ যে বসে নেই তা বুঝাই যায়। কোরিয়া উপদ্বীপকে যদি আণবিক অস্ত্রমুক্ত করতে হয় তবে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীন ও আমেরিকাকে খুবই ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার মাঝে থাকতে হবে এবং খোলা মন নিয়ে সব সমস্যার প্রতি নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে জাপানকেও সঙ্গে রাখতে হবে।

নিরস্ত্রীকরণ সম্ভব হলে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় আমেরিকার সৈন্য আর থাকতে হবে না। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে নিরস্ত্রীকরণ সম্ভব হলে আমেরিকার পাহারাধারীর ব্যয়ও সংকুচিত হবে। তবে পম্পেও যে সুরে কথা বলছেন তাতে মনে হয় কিম জং উন কোমরে দড়ি দেওয়া একজন কয়েদি। এখন কিছু পাবে না। নিরস্ত্রীকরণ সম্পূর্ণ হলেই তার মুক্তি। অনুরূপ কথায় তো সমস্যার সমাধান হবে না।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।

bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com