যেমন ধরুন সদ্য সমাপ্ত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে যদি এখন প্রশ্ন করা হয় এই নির্বাচনে জিতল কে, তাহলে তার সহজ স্বাভাবিক উত্তর হওয়া উচিত ছিল আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম, যিনি ২ লাখেরও অধিক ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থীকে পরাজিত করে গাজীপুরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু আদতে বিষয়টি বোধহয় তত সরল নয়। নির্বাচনটি ঘিরে নানা তরফে এত কথা শোনা যাচ্ছে যে চট করে এর একটি সহজ উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন। আওয়ামী লীগের তরফে যখন দাবি করা হচ্ছে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, মানুষ বিএনপির রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করে দেশের অব্যাহত উন্নয়ন, অর্জন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে রায় দিয়েছে, ঠিক তখনই ঘৃণাভরে নির্বাচনি ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে পুনরায় ভোটগ্রহণের দাবি করেছে বিএনপি। ওবায়দুল কাদের অবশ্য বিষয়টি খোলাসা করে বলেছেন যে ‘জিতলে আছি হারলে নাই’ নীতিতে চলছে বিএনপি। তার ভাষায় বিএনপি ‘নালিশ পার্টি’, সুতরাং এই নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাবার কিছু নেই।
তবে মুশকিল হলো নির্বাচনটি নিয়ে কেবল যদি বিএনপি আপত্তি তুলতো তাহলে বলার কিছু ছিল না। নালিশ পার্টি নালিশ করবে তা নিয়ে অস্থির হলে চলে না। কিন্তু সমস্যা হলো বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকগুলো এই নির্বাচন নিয়ে গত কয়দিন যাবৎ শিরোনাম করতে গিয়ে লিখেছে, ‘নিয়ম অনিয়মের নির্বাচন’। বলেছে, ‘বাইরে সুনসান ভেতরে গড়বড়’, ‘দিনভর বহিরাগতদের অবস্থান’ কিংবা ‘আওয়ামী লীগ জিতেছে গণতন্ত্র হেরেছে’, ‘খুলনার অভিযোগ গাজীপুরেও’, ‘খুলনার চেয়েও একধাপ এগিয়ে’, ‘অনেক কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট, ব্যবধানও বেশি’– ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি বিবিসি এই নির্বাচন নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে তাদের হতাশার কথাই ব্যক্ত করেছে। জাতীয় দৈনিকগুলোর কল্যাণে এই নির্বাচনের যে চিত্র আমরা জানতে পেরেছি তাতে মূলত বলা হয়েছে ভোটারদের কাছ থেকে ব্যালট নিয়ে সিল মারা, বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, ব্যালট ছিনতাই, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্টদের হুমকি ও কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া, কেন্দ্রের ভেতর বাইরে বহিরাগতদের দাপট ইত্যাদি। লক্ষণীয় বিষয় হলো এই সকল অন্যায় অনিয়ম হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটা বড় অংশকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে, যাতে প্রশাসন ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
একটি কথা বারবারই উঠেছে। তা হলো বিএনপি প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট ছিল না। বিএনপির মতো বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল, যারা বারবারই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় গেছে তাদের কেন পোলিং এজেন্ট থাকবে না? এবার নাকি খুলনার তিক্ত অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে গাজীপুরে তিন সেট এজেন্ট প্রস্তুত রাখা হয়েছিল যাতে এক সেট আটক বা নির্যাতনের শিকার হলে পরবর্তী সেট দায়িত্ব নিতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো তিন সেট এজেন্ট তেমন কাজে আসেনি। কারণ, তাদের কাউকে ভোটের আগের রাতে, কাউকে ভোটের দিন ভোরে বাড়ি থেকে,কেন্দ্রের ভেতর ও বাইরে থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ভয়ে আতঙ্কে বা গ্রেফতার এড়াতে অনেকে বাড়ি থাকতে না পারলেও শেষ রক্ষা হয়নি। কেন্দ্রের ভেতর বুথ থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ বা ডিবি তুলে নিয়ে গেছে তাদের। ভয়ে নাম পরিচয় গোপন করা সত্ত্বেও এমন ৪২ জন সম্পর্কে জানা গেছে, যারা বিএনপি প্রার্থীর এজেন্ট বা কেন্দ্র কমিটির সদস্য ছিলেন। এদের গাজীপুর থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে যাতে তারা কোনও ভূমিকা পালন করতে না পারে এবং একই সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা অন্য এজেন্টদের মধ্যেও ভীতির সঞ্চার করেছে, যাতে তারা মাঠ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। জানের মায়া সবারই আছে, নাকি? আরও মজার বিষয় হলো, ভোটের আগের দিন সন্ধ্যায় এলাকা থেকে সক্রিয় নেতাকর্মী ধরে নিয়েছে সাদা পোশাকের পুলিশ, যাদের পরে ঢাকার কেরানীগঞ্জ কারাগারে পাওয়া যায়। গাজীপুরে শেষের কয়েক দিন বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর গ্রেফতারের এতটাই স্টিমরোলার চালান হয় যে অবশেষে নির্বাচনের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা আসে এই গণগ্রেফতার বন্ধ করার জন্য। যদিও ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। গ্রেফতারের শিকার হয়েছে অগণিত নেতাকর্মী আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। এই আতঙ্ক সৃষ্টিই ছিল মূল উদ্দেশ্য। পুলিশের গাড়িতে ঘুরেছে সরকারি দলের প্রার্থী, অন্যদিকে বিরোধী দল ব্যস্ত ছিল জান বাঁচানোর খেলায়। নির্বাচনের এত চমৎকার এবং সুপরিকল্পিত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ কে দেখেছে কবে? আর সকল মুশকিলের আসান-স্বরূপ একজন এসপি তো ছিলেনই সর্বক্ষণ।
গাজীপুরের নির্বাচনটি এতটাই সুনিয়ন্ত্রিত এবং সুপরিকল্পিত ছিল যে ফলাফল ঘোষণার ৪ দিন পার হলেও এর বিশ্লেষণ চলছে এবং নানা নিত্যনতুন আঙ্গিকের দেখাও মিলছে। ২৮টি সিভিল সোসাইটি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ‘ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ’ বা ‘ইডব্লিউজি’ তাদের প্রাথমিক রিপোর্টে বলছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাড়ে ৪৬ শতাংশ কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। এত নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকার পরও যখন প্রায় ৫০ শতাংশ কেন্দ্রেই অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায় তখন আর যাই হোক সেই নির্বাচনকে সুষ্ঠু বলার কোনও রাস্তা থাকে না। নির্বাচন কমিশন, আওয়ামী লীগ সমর্থক নেতাকর্মী এবং একশ্রেণির সুশীল বুদ্ধিজীবী বলার চেষ্টা করছেন ৪২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে অনিয়মের অভিযোগে মাত্র ৯টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়েছে, শতকরা হিসাবে যা ২ শতাংশের বেশি হবে না। মজা হলো, অনিয়ম সবক’টি কেন্দ্রেই হয়েছে, স্থগিত হয়েছে বা প্রকটভাবে সামনে এসেছে কেবল ৯টি কেন্দ্র। ধরা যাক একটি এলাকায় ২ লাখ লোকের বাস। আমরা যদি সেখানে কোনও জরিপ চালাই তাহলে ২০০ থেকে ৫০০ জনের ওপর জরিপ করে সেটাই ওই এলাকার জনমতের প্রতিফলন বলে ধরে নেবো। এটাই রীতি। আর পর্যবেক্ষক বা সাংবাদিক কখনোই সব কেন্দ্রে যান না, যাওয়া সম্ভবও না। একজন অভিজ্ঞ নির্বাচন বিশ্লেষক বলছিলেন যে বাংলাদেশের নির্বাচনের ধারাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ৯১ পূর্ব নির্বাচন, ৯১ থেকে ২০০৮ এবং ২০০৮ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। দুঃখজনক হলেও সত্য, ৯১ পরবর্তী যে নির্বাচনের ধারা আমরা তৈরি করেছিলাম তা আর ধরে রাখতে পারিনি। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনি ইতিহাস পুরো বিষয়টিকেই বদলে দিয়েছে। এখন ভোট মানেই পুলিশ, প্রশাসন, ক্যাডার ব্যবহার করে সরকার দলীয় প্রার্থীর জয়লাভ। ভোটের সঙ্গে এখন আর ভোটারের তেমন সম্পর্ক নেই।
সম্প্রতি গাজীপুর আর খুলনা নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগের কথা জানাতে গিয়ে সরকারি দলের তোপের মুখে পড়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। এদেশের নির্বাচন নিয়ে একমাত্র ভারত ছাড়া আর কোনও দেশের মন্তব্য শুনবার মতো ধৈর্য সম্ভবত সরকারের অবশিষ্ট নেই।
গাজীপুর বা খুলনা সিটি নির্বাচন ছিল স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এতে হারলেও সরকার পরিবর্তনের কোনও সুযোগ ছিল না। বরং নির্বাচনটা যদি সত্যিকার অর্থেই সুষ্ঠু হতো তাহলে সরকারের দাবি যে তাদের অধীনে ভালো নির্বাচন সম্ভব সেই দাবিই জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা পেত। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, আমরা অতীত সরকারের খারাপ নজিরগুলো কেবল যে চর্চা করি তাই নয়, বরং আরও শতগুণ খারাপ কী করে করা যায় তার প্রতিযোগিতায় নামি। তাই আজকে যেকোনও নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে গেলেই শুনতে হয় ‘মাগুরা নির্বাচনে’র কথা। এই ‘মাগুরা নির্বাচনকে’ আদর্শ ধরে এগোনোর ফলে প্রতিটি নির্বাচনই এখন ‘মাগুরা মার্কা’ নির্বাচন। পরিশেষে বলি, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স আর নির্ভুল ভোটার তালিকা দিয়ে কী হবে যদি ভোটার তার ভোটটাই দিতে না পারে?
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট