সড়কে মৃত্যুর মিছিল, দায় কার?

রেজানুর রহমানসড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু এখন যেন কোনও খবরই নয়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে,  এই বছরের প্রথম পাঁচ মাসে সারাদেশে ২ হাজার ৩৩৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজার ৪১১ জন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব দুর্ঘটনার ব্যাপারে আইনগত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় কুকুর-শিয়ালের মৃত্যু হলে যতটা শোরগোল হয়, তার ছিটেফোঁটাও হয় না মানুষের মৃত্যুতে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হবে−এটাই তো স্বাভাবিক। কাজেই এ নিয়ে কথা বলার তো কিছু দেখি না। অথচ কী নির্মম এ ভাবনা! সারাদেশে প্রায় প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। ফলে শত শত পরিবারের ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে অনিশ্চিত। তবু, এক্ষেত্রে প্রতিরোধের সমন্বিত কোনও উদ্যোগ নেই। দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সড়ক দুর্ঘটনায় অসহায় মানুষের অকাল মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বেশকিছু ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়ার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটা মহামারির আকার ধারণ করেছে বলে অনেকে মনে করছেন।
গত কয়েক মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যুর অসংখ্য ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি আমরা। এরমধ্যে তিতুমীর কলেজের মেধাবী ছাত্র রাজিব হোসেনের মৃত্যুর ঘটনা গোটা দেশে আলোড়ন তুলেছিল। দু’টি বাসের বেপরোয়া গতির কবলে পড়ে রাজিব তার ডান হাত চলে যায়। হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত  তিনি না ফেরার দেশেই চলে যান।
দুই বাসের মাঝখানে ঝুলে আছে একটি কাটা হাত! কী বীভৎস দৃশ্য! এখনও চোখের সামনে ভেসে উঠলে বুকের ভেতর যন্ত্রণা মোচড় দেয়। সেই একই  দৃশ্য আবারও দেখতে হলো পত্রিকার পাতায়। যদিও এবার দেশের অনেক বড় পত্রিকায় মর্মান্তিক এই সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ তেমন গুরুত্ব পায়নি। পাবে কী করে? প্রতিদিন একই টাইপের খবর সৃষ্টি হলে তো সেটার নিউজভ্যালু থাকে না। সে কারণে রাজীবের চেয়ে আরও হৃদয়বিদারক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র শাহরিয়ার সৌরভ। একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় এই মর্মান্তিক ঘটনার বীভৎস ছবি প্রকাশিত হয়েছে। কঠিন হৃদয়ের মানুষের পক্ষেও বোধকরি এই ছবিটির দিকে তাকানো সম্ভব নয়। বাসের নিচে সৌরভের নিথর দেহ পড়ে আছে। শুধু বুক থেকে দুই পা দেখা যায়। একটা হাত পড়ে আছে সড়কের ওপর। সৌরভের বন্ধুরা জানিয়েছে, ১লা জুলাই সকাল ১১টার দিকে কালসী ফ্লাইওভার থেকে সৌরভ মোটরসাইকেল চালিয়ে নামছিলেন। হোটেল র‌্যাডিসনের কাছে বসুমতি নামে একটি যাত্রীবাহী বাস তাকে ধাক্কা দেয়। বাসটি অনেক দূর টেনে নেয় সৌরভকে। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই সৌরভের মৃত্যু হয়। কয়েক বছর প্রেমের পর পারিবারিকভাবে গত বছর বিয়ে করেছিলেন সৌরভ। তার স্ত্রী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ব্যাচের ছাত্রী। সুন্দর একটা সংসার সাজিয়েছিলেন তারা। সৌরভকে হারিয়ে তার স্ত্রী এখন দিশেহারা। এর আগে বাসের চাপায় হাত হারানোর পর না ফেরার দেশে চলে যাওয়া তিতুমীর কলেজের মেধাবী ছাত্র রাজিব হোসেনের পারিবারিক পরিচয় সারাদেশের মানুষ জানে। মা-বাবা হারানো রাজিব হোসেন অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় পড়তে এসেছিলেন। এতিম দুই ভাইকেও তার দেখাশোনা করতে হতো। বাসের চাপায় রাজিবের অকাল মৃত্যুর পর পরিবারটি অর্থাৎ এতিম দুই ভাইয়ের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

১৭ মে শনির আখড়ায় মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের ওপরে বাসের ধাক্কায় মারা যান ঢাকা ট্রিবিউনের বিজ্ঞাপন বিভাগের কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন। পরিবারের উপাজর্নক্ষম লোকটিকে হারিয়ে এই পরিবারটিও অনেকটা বিমূঢ় সময় পালন করছে।

আসলে যেকোনও কারণেই হোক, একজনের মৃত্যু মানেই একটি পরিবারের কান্না। তিনি যদি হন পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, তাহলে পুরো পরিবারটির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায়। এই বছরে গত পাঁচ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৪১১ জনের মৃত্যু মানেই সারাদেশে ২ হাজার পরিবারে কান্নার রোল উঠেছে। এরমধ্যে অর্ধেকও যদি পরিবারের মূল উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হন তাহলে হিসাব অনুযায়ী, দেশের একহাজার পরিবার তাদের অভিভাবককে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। দিনে দিনে দিশেহারা পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। অথচ সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না।

গত ঈদের ছুটিতে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যুর ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং এ ব্যাপারে প্রতিরোধমূলক নানা ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো—দূরপাল্লার যাতায়াত ব্যবস্থায় কোনও ড্রাইভার একনাগাড়ে ৫ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে পারবেন না। সড়ক পথে জায়গায় জায়গায় ড্রাইভারদের জন্য বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এখনও প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর হয়নি।

আসলে সড়ক পথে দেশের প্রচলিত অনেক আইনই মানা হচ্ছে না। আইনে আছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়ক পথে নামানো যাবে না। অথচ ফিটনেসবিহীন গাড়ি অবাধে সড়কপথে চলাচল করছে। দূরপাল্লার যাত্রাপথে একটি নির্দিষ্ট গতিতে গাড়ি চালানোর নির্দেশ আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই নির্দেশ মানা হয় না। বরং কে কাকে ওভারটেক করে কত দ্রুত গন্তব্যে যেতে পারবেন, এই প্রতিযোগিতায় মেতে থাকেন অনেক ড্রাইভার। সড়কপথে হাইওয়ে পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায় মাঝেমধ্যে। কিন্তু সড়ক পথের অনিয়ম প্রতিরোধে তাদের তেমন সোচ্চার হতে দেখা যায় না।

তাহলে কি সড়ক পথে অনিয়ম-অনাচার চলতেই থাকবে? সড়ক দুর্ঘটনায় অসহায় মানুষের মৃত্যুর মিছিল বাড়তেই থাকবে? ভাবা যায় মাত্র ৫ মাসে শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হয়েছে। ২ হাজার মানুষের ২ হাজার পরিবার। তাদের কথা ভাবুন তো একবার। এর মধ্যে অনেকেই ছিলেন পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।  ওই পরিবারগুলো চলছে কী করে? 

প্রিয় পাঠক, আজকের লেখাটি শেখ করার আগে একবার তাকাতে বলি শাহরিয়ার সৌরভের নিথর দেহটির দিকে। সড়কের ওপর একটি বাসের নিচে তার নিথর দেহটি পড়ে আছে। কল্পনা করুণ তো একবার। মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে এক তরুণ। একটি বাস তাকে ধাক্কা দিলো। বাসের নিচে পড়ে তার দেহ ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে অনেক দূর চলে যায়। কী নির্মম, নিষ্ঠুর দৃশ্যটি!

পত্রিকায় ছাপা হয়েছে এই নির্মম ঘটনার ছবি। দুই বাসের মাঝখানে রাজিব হোসেনের হাত চাপা পড়ার সেই নিষ্ঠুর ছবিও দেখেছি। এ ধরনের নিষ্ঠুর ছবির মিছিল বেড়েই চলেছে। এর কি কোনোই প্রতিকার নেই?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক, আনন্দ আলো