উন্নয়নের গোপন রহস্য

রুমীন ফারহানাবাংলাদেশে গত কয়েক বছরের রাজনীতির ভাষা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে— সরকারি দলের সভা-সমাবেশ, প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে শুরু করে পাতিনেতার নির্বাচনি প্রচারণা, টক শো, সরকারি বিজ্ঞাপন, স্থানীয় থেকে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত সর্বত্রই যে শব্দটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, তা হলো ‘উন্নয়ন’। বাংলাদেশ নাকি এমনই উন্নতি করেছে যে, বিশ্বের তাবৎ মোড়ল রাষ্ট্র বাংলাদেশের উন্নয়নের রহস্য জানতে চায়।
গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে ২০১৪ সালের পট পরিবর্তনের পরে, উন্নয়নকে সুপরিকল্পিতভাবে গণতন্ত্রের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফেলা হয়েছে। যেন একটি থাকলে অন্যটি না থাকলেও চলে। উন্নয়নের যে তত্ত্ব আওয়ামী লীগ হাজির করেছে তা হলো ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’, ‘সীমিত গণতন্ত্র’ কিংবা ‘বেশি উন্নয়ন, কম গণতন্ত্র’ ইত্যাদি। এসব অবশ্য আমাদের কমবেশি জানা। কারণ আইয়ুব খান তার সামরিক শাসনের সময়ও এ ধরনের একটি তত্ত্ব দিয়েছিলেন। সেই সামরিক জান্তারও ‘উন্নয়ন’ শব্দ নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ ছিল। এমনকি উন্নয়নের দশকও পালন করেছিলেন তিনি। যদিও অবশ্য এর পরপরই তার পতন ঘটে।

আরও একটি মজার তত্ত্ব সরকার আবিষ্কার করেছে। উন্নয়নের জন্য নাকি সরকারের ধারাবাহিকতা আবশ্যক। অর্থাৎ উন্নয়ন চাইলে একই সরকারের বারবার ক্ষমতায় থাকা জরুরি, সেটা যে কায়দায়ই হোক না কেন। এর পেছনে কী প্রমাণ আছে তা সরকারই ভালো বলতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, উন্নত দেশগুলোতে এমনকি ঘরের পাশে ভারতেও সরকার আসে সরকার যায়। তাতে উন্নয়নে কোনও ব্যাঘাত ঘটে বলে শোনা যায় না। সরকারের মতে, পরিবর্তন মানেই উন্নয়নের পথে হোঁচট খাওয়া। উন্নয়নের এ নতুন তত্ত্ব স্বাভাবিকভাবে কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। যেমন—

১. উন্নয়ন বলতে কী বোঝায়?

২. গণতন্ত্রের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক কী?

৩. একটি অপরটির বিকল্প হতে পারে কিনা?

৪. গণতন্ত্র ও সুশাসন ছাড়া উন্নয়ন কতটা টেকসই হতে পারে?

৫. উন্নয়নের দোহাই পেড়ে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রক্ষায় যে কোনও উপায় অবলম্বন কতটা যুক্তিযুক্ত?

৬. গণতন্ত্রের বিকল্প কী হতে পারে?

৭. সবচেয়ে জরুরি হলো মানুষ আসলে কী চায়?

গত কয়েক বছরে সরকারের যে প্রচার-প্রচারণা, তাতে মনে হতেই পারে উন্নয়ন মানেই প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি ও কিছু ব্রিজ, ফ্লাইওভার নির্মাণ অর্থাৎ অবকাঠামোগত উন্নয়ন। মজার বিষয় হলো— এর সঙ্গে সুশাসন, মানুষের জীবনযাত্রার মান, মানবসম্পদ উন্নয়ন, আইনের শাসন, বৈষম্য বৃদ্ধি, দারিদ্র দূরীকরণের হার কমে আসা, সর্বস্তরে জবাবদিহিতার অভাব, অর্থনৈতিক খাতের চরম নৈরাজ্য, বিচারহীনতার বিষয়গুলো সচেতনভাবে রেখে দেওয়া হয়েছে আলোচনার বাইরে। যে উন্নয়ন সাধারণ মানুষের জীবন স্পর্শ করে না, সেই উন্নয়ন কোনোভাবেই সার্বিক অর্থে কল্যাণকর হতে পারে না।

‘সাপ্তাহিক’-এর ৪ জানুয়ারি ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর ২০১৭-১৮ সালের অর্থনৈতিক পর্যালোচনা বলছে— যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দাবি করা হচ্ছে, তার সঙ্গে জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বৈষম্য আর কমেছে দারিদ্র্য দূরীকরণের হার। যাকে সহজ ভাষায় বললে দাঁড়ায়— এখানে ধনী আরও ধনী হচ্ছে, দরিদ্র হচ্ছে দরিদ্রতর। যেখানে ২০০৫ থেকে ২০১০ সালে দারিদ্র্য দূরীকরণের হার ছিল গড়ে ১ দশমিক ৭ শতাংশ, সেখানে ২০১০ থেকে ২০১৬ সালে তা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ২ শতাংশে। একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে, অতি দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রেও। যা ২০০৫ থেকে ২০১০ সালে ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশ, সেটাই ২০১০ থেকে ২০১৬ সালে কমে এসেছে ০ দশমিক ৮ শতাংশে।

গবেষণা বলছে— দেশের দরিদ্রতম ১০ শতাংশ লোক যেখানে ২০১০ সালে মোট জাতীয় আয়ের ২ শতাংশের অধিকারী ছিল, ২০১৬ সালে তা কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ০১ শতাংশে। অন্যদিকে দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ লোক ২০১০ সালে মোট জাতীয় আয়ের ৩৫ দশমিক ৮৪ শতাংশের মালিক হলেও ২০১৬ সালে তারা ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশ আয়ের অধিকারী হয়। আরও সহজ ভাষায় বলতে গেলে, গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি বলছে— বাংলাদেশে গত ছয় বছরে জিডিপি বৃদ্ধির দিনগুলোতে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় বেড়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। আর সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে ১ হাজার ৫৮ টাকা।

কথায় কথায় এখন বলা হয় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কথা। মাথাপিছু আয় আরেক শুভঙ্করের ফাঁকি। এখানে হলমার্ক, ডেসটিনি, শেয়ারবাজার লুটেরা, সরকারি, বেসরকারি ব্যাংকের বড় বড় ঋণখেলাপির অবিশ্বাস্য অঙ্কের লুটের সঙ্গে গড় করা হয় দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক, গার্মেন্ট কর্মী আর রিকশাচালকের আয়। এতে না স্পষ্ট হয় লুটেরা শ্রেণির অবিশ্বাস্য লুট, না বোঝা যায় শ্রমজীবী মানুষের দৈন্যদশা। পুরোপুরি লেজেগোবরে কাণ্ড।

উন্নয়নের এই রাজ্যে বিনিয়োগ থাকে স্থবির হয়ে আর লাফিয়ে বাড়ে বেকারের সংখ্যা। পরিসংখ্যান বলছে, ১৬ কোটি মানুষের দেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখ। দেশে তৈরি হয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল আর দেশে কাজ না পেয়ে বিদেশে পাড়ি দেয় ১ কোটির ওপর মানুষ। যাদের কাঁধে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি, যাদের ঘামেভেজা টাকায় আমরা নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখি, সেই প্রবাসী শ্রমিক, গার্মেন্ট কর্মী আর কৃষকের জীবনমানের কোনও উন্নতি হয় না।

বলে রাখা ভালো, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরির শীর্ষে আছে বাংলাদেশের নাম। বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে গিয়ে ১৩ বছরে লাশ হয়ে ফিরেছেন ৩৩ হাজার শ্রমিক। প্রতিদিন সংবাদের বড় অংশ জুড়ে থাকে সৌদি আরব থেকে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার খবর। তাদের অনেকে লাশ হয়ে, কেউবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফিরেছেন। রানা প্লাজার বীভৎসতা বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কতটা অনিরাপদ পরিবেশে কাজ করে আমাদের কর্মীরা। সবচেয়ে কম মজুরি আর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে কাজ করে বাংলাদেশের শ্রমিক। যেকোনও উৎসবে মালিক যখন প্রমোদভ্রমণে যান, তখনও হয়তো শ্রমিকের তিন মাসের বেতন বাকি। কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না আর সরকার খাদ্য উদ্বৃত্তের গল্প শোনায় মানুষকে। দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের পীঠস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যায্য আন্দোলন করতে গিয়ে কৃষকের সন্তান খায় হাতুড়ির বাড়ি, যায় রিমান্ডে, শোনে ৩৮ টাকায় খাবার আর ১৫ টাকায় বাসস্থানের খোটা। সরকারের একবারও মনে পড়ে না এই সাধের বিশ্ববিদ্যালয় চলে আমাদের টাকায় যেখানে মিশে আছে কৃষক, শ্রমিকসহ মেহনতি মানুষের ঘামেভেজা রক্ত জল করে আনা টাকা।

জনগণের টাকায় একদিকে লুটেরা শ্রেণি বছরে ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার করে আর হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে বছরে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা রেমিটেন্স পাঠান আমাদের প্রবাসী ভাইরা। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বলছে— গত ১০ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা, যা আমাদের জাতীয় বাজেটের দুই গুণ। আন্তর্জাতিক ঝুঁকি যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে— বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে। যদিও রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক নতুন ব্যাংকের অনুমোদন পাচ্ছে ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষেরা। আইন করে ব্যাংকগুলো তুলে দেওয়া হচ্ছে এক একটি পরিবারের হাতে। মূলধন ঘাটতিতে ভুগছে ব্যাংক। এখন ব্যাংকের নীতি নির্ধারিত হয় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকের (বিএবি) মাধ্যমে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি কার্যকর করে মাত্র। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তো নিজের ভারবহনে সক্ষমতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। নজীরবিহীনভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নাই হয়ে গেছে ৮০০ কোটি টাকা, যার বিচার তো দূরস্থান, তদন্ত রিপোর্ট পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। এদিকে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপী ঋণ নিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে শীর্ষে আছে বাংলাদেশ।

সরকারের লোক কথায় কথায় চীন ও সিঙ্গাপুরের উদাহরণ টেনে বলতে চায়, সেখানে তো গণতন্ত্র নেই, কিন্তু উন্নয়ন হচ্ছে। এখানে মনে রাখা দরকার, সেসব দেশে গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকলেও উন্নয়ন হয়েছে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। অন্যদিকে পৃথিবীর বহু দেশ আছে যেখানে গণতন্ত্র ও সুশাসন দুটোরই ঘাটতি ছিল। ফলে উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়েছে। যেমন ফিলিপাইন কিংবা জিম্বাবুয়ে। সেইসব দেশের মতো বাংলাদেশেও গণতন্ত্র আর সুশাসনের চরম ঘাটতি আছে। প্রশ্ন জাগে, এত উন্নয়নের পরও সরকার কেন বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে পারছে না? এটা প্রমাণিত যে সুশাসনের অভাব মানুষকে নিরাপত্তাহীন করে বিনিয়োগ বিমুখ করে তোলে। গণতন্ত্র আর সুশাসনহীন উন্নয়নের ছোট্ট একটি উদাহরণ হলো— বিশ্বে নজিরবিহীন ব্যয়বহুল রাস্তা নির্মাণ হয় বাংলাদেশে, অথচ সবচেয়ে খারাপ রাস্তার তালিকায় এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, ঘরে ঘরে উন্নয়নের খবর পৌঁছে দিতে। বলেছেন, যত উন্নয়ন তিনি করেছেন তাতে মানুষের ভোট না দেওয়ার কোনও কারণ নেই। ভোট না দিলে বুঝতে হবে উন্নয়নের প্রচার সঠিকভাবে হয়নি। প্রকৃত উন্নয়ন যা গণমানুষের জীবনকে উন্নত করে তা প্রচারের জন্য মাইক বা বিলবোর্ড লাগে না। মানুষ আপনাআপনি তার সুফল পায়, মনেও রাখে।

কিন্তু যে উন্নয়ন কেবল গুটিকয়েক মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে, যাতে সাধারণ মানুষের প্রতি বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই জোটে না, তেমন উন্নয়নের প্রচার যত জোরেই হোক না কেন তা মানুষকে স্পর্শ করে না। গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনের শাসন ও ন্যায্যতা ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় কাজ না করে যতই দুর্নীতি আর লুটপাট সহযোগী অবকাঠামোগত উন্নয়নের গল্প শোনানো হোক না কেন, মানুষ কিন্তু ঠিকই বোঝে। কিছু মানুষকে হয়তো কিছু সময়ের জন্য বোকা বানানো যায়। কিন্তু সব মানুষকে সবসময় বোকা বানানো অসম্ভব।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট