দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীবেলাগাম হয়ে উঠেছে দেশের অবস্থা। কারও কর্মকাণ্ডে দেশ বিশৃঙ্খলায় ডুবে যাক তা যেমন প্রত্যাশিত নয়, আবার কারও লুটপাটে দেশ তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হোক, তাও দেশের মানুষ কামনা করে না। বড়পুকুরিয়ায় কয়লা নিয়ে যে কেলেঙ্কারি হয়েছে তাতে মনে হয়েছে কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি করে কারও জিম্মায় জিনিসের হেফাজতের দায়িত্ব প্রদানও নিরাপদ নয়। এ কয়লা বাইরের লোক গিয়ে লুট করে নেয়নি, দায়িত্বপ্রাপ্তরাই প্রতিদিন এক ট্রাক দু-ট্রাক করে বিক্রি করে কয়লা শেষ করেছে। বেড়া যদি ক্ষেত খায় তবে রাষ্ট্র চলবে কী করে?
এই বিষয়টা নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত কমিটির ওপর ভরসা করতেও ভয় লাগে। কারণ, দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ করে তারা যদি রিপোর্ট দেয় ১৫ বছরব্যাপী স্টকে কয়লা হ্যান্ডলিং করতে গিয়ে সিস্টেমলসের কারণে এ ঘাটতি দাঁড়িয়েছে তবে আত্মসাৎকারীরা তো একটা অজুহাত খুঁজে পাবে। তারা অনুরূপ কোনও অজুহাত সৃষ্টির পাঁয়তারা করবে নিশ্চয়ই। তদন্ত যারা করছে তারাও তো এদেশের মানুষ। তারাও কেউ যুধিষ্ঠীর ধর্মপুত্র নন। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে চোরে চোরে দেশ ভরে গেছে। এক চোর আরেক চোরের পাহারাদার তো হতে পারে না।

ব্যাংক লুটের ঘটনায়ও তদন্ত কমিটি হয়েছিল। শেখ আব্দুল হাইকে তদন্তের আওতায় আনার জন্য বাইরের মানুষকে দাবি তুলতে হয়েছে অথচ তাকে সর্বপ্রথম গ্রেফতার করে জেরা জবানবন্দির সম্মুখীন করা উচিত ছিল। এসব কে করে, কেন করে জানি না। অথচ এসব দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয়ের প্রতি অবহেলা করলে মানুষের সন্দেহ গিয়ে পড়ে সরকারের ওপর। অফিসারের প্রতিপক্ষ নেই, সরকারের প্রতিপক্ষ পদে পদে। ছোট বড় বিরোধী দল আছে, মিডিয়া আছে। তারা তো মুখিয়ে আছে তিলকে তাল বানানোর জন্য। প্রধানমন্ত্রী আর মন্ত্রী পরিষদ শুধু সরকার নয়, হাজার হাজার অফিসারও সরকারের অংশ। তাদের যেকোনও কর্মকাণ্ডের জন্য সরকার দায়িত্ববান থাকে।

ব্যাংকের বিষয়গুলো নিয়ে সরকার যদি কঠোর ভূমিকা না নেয় আর ব্যাংক ব্যবস্থায় অনিয়মের রাজত্ব চলতে থাকে তবে অনিয়মের মাঝে ব্যাংক ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা ফিলিপাইনের রেজাল ব্যাংক ‘ছক্কাপাঞ্জা’ করে নিয়ে গেছে। কিছু টাকা উদ্ধার করাও সম্ভব হয়েছে। এ টাকা নেওয়ার পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনও অবহেলা ছিল কিনা এসব বিষয় এখনও স্থির হয়েছে বলে জানি না।

এই সমস্ত বিষয়ে দেখলাম ছাত্রদের চলতি আন্দোলনে স্কুলে আসা এক ‘মা’ মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেছে যে শুধু নিরাপদ সড়কের জন্য এ আন্দোলন নয়, ছাত্রদের মাঝে রাষ্ট্রীয় বহু বিষয়ে ক্ষোভ আছে, তারই বহিঃপ্রকাশ এ আন্দোলন। তার মাঝে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরি, স্বর্ণে ভেজালের কথা, বড়পুকুরিয়ার কয়লা চুরি ইত্যাদির কথা এই ভদ্র মহিলা উল্লেখ করেছেন। বর্তমান উন্নত যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে কোনও কিছু গোপন করা সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং সবকিছুর প্রকৃত অবস্থা যখন গোপন করা যাচ্ছে না তখন সকল স্তরে সচ্ছতার নিশ্চয়তা থাকা প্রয়োজন।

নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে চুরি হওয়া ১০ কোটি ১০ লাখ ডলারের মাঝে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ডলার পাওয়া গেছে ফিলিপাইন থেকে, আরও ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার ফেরত আসার কথা, অবশিষ্ট ৩ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের জন্য রেজাল ব্যাংক এবং নিউ ইয়র্ক রিজার্ভ ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করা প্রয়োজন। লিমিটেশন পিরিয়ড সম্পর্কে জানি না সরকার সে বিষয়ে সতর্ক আচে কিনা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বর্ণের ভেজাল সম্পর্ক একটা কথা বাজারে ছড়ালো। অর্থমন্ত্রী ছিলেন না। অর্থ প্রতিমন্ত্রী তার অনুপস্থিতিতে বিষয়টি দেখভাল করলেন। অর্থমন্ত্রী এসে বললেন তিন কেজি স্বর্ণে কিছু ভেজাল দেখা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভোল্টের মজবুত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে বলে অর্থমন্ত্রীর বয়ান থেকে জেনেছি। এরপরও ভেজালের প্রশ্ন আসলো কেন? এসব স্বর্ণ চোরাচালানীদের কাছ থেকে আটক হওয়া স্বর্ণ। এ ভেজাল কি আটকের আগের ভেজাল, না পরের ভেজাল তা স্থির হওয়া প্রয়োজন। আমরা আশা করবো সরকার এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং চোরাচালানীদের থেকে আটক স্বর্ণ নিলামে বিক্রি করে দেবেন। বহু বছর ধরে বিশেষ করে এ সরকারের আমলে স্বর্ণের কোনও নিলাম হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সতর্ক গৃহিণীর মতো। এখানে ওখানে কিছু স্বর্ণ কিছু অর্থ মজুত করে রাখেন দুঃসময়ে যেন কষ্ট পোহাতে না হয়। সর্বত্র চোরের উপদ্রব হলে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা তো সম্ভব হয় না। সুতরাং স্বর্ণগুলো নিলামে বিক্রি করাই উত্তম হবে।

বড়পুকুরিয়ায় নাকি ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪  টন কয়লা নেই। পরিমাণের অংক খুবই ব্যাপক। কঠিনভাবে তদন্ত করতে হবে এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যতায় সর্বত্র প্রশাসন তার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না। বর্তমানে কয়লাভিত্তিক বহু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। কোটি কোটি টন কয়লার আমদানি হবে। কোটি কোটি টনের মজুত গড়ে উঠবে। বিসমিল্লায় দুর্নীতির মূলে যদি কঠোর আঘাত করা না হয় তবে ভবিষ্যতে প্রত্যেক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা নিয়ে কেলেঙ্কারি লেগে থাকবে।

কঠিন শিলা খনিতেও দুর্নীতি হয়েছে। আরও তদন্ত কমিটি হয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো দুর্নীতির মূল উৎপাটনের ব্যাপারে সরকার যেন কঠোর কঠিন ভূমিকায় অবস্থান নেন। এই উপমহাদেশের বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান তিন দেশেই দুর্নীতি এত ব্যাপকরূপ পরিগ্রহ করেছে যে সবকিছুর অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। সুতরাং কেউ না কেউ উদ্ধার কাজে অবতীর্ণ হতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, ভালো কাজ হারিয়ে যায় না। ইতিহাসের কাল উত্তীর্ণ নরপতিরা কোনও না কোনও ভালো কাজ করেই কাল উত্তীর্ণ হয়েছেন।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com