সাফ ফুটবলের সেমিফাইনাল পর্যন্ত উঠে আসাটা মালদ্বীপের জন্য ছিল অনেকটা লটারিতে টিকেট মিলে যাওয়ার মতো। গ্রুপ পর্বে কোনও খেলায়ই গোল করতে পারেনি মালদ্বীপ। একটি ম্যাচ গোলশূন্য ড্র রেখে টস ভাগ্যে সেমিফাইনালে উঠে যায় মালদ্বীপ। কিন্তু ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে অবিশ্বাস্য রকমের পারফরম্যান্স দেখালো দ্বীপের দেশ মালদ্বীপ। শক্তিধর নেপালকে হারালো। তাও আবার ৩-০ গোলে। কীভাবে এটা সম্ভব হলো? যাদের কিনা শূন্যহাতে দেশে ফেরার কথা তারাই হয়তো বিজয় মুকুট নিয়ে শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরবে। অন্যরা তা চেয়ে চেয়ে দেখবে। অনেকটা গানের কলির মতো– “তুমি চলে গেলে, চেয়ে চেয়ে দেখলাম... আমার বলার কিছু ছিল না।’
আচ্ছা, এই যে মালদ্বীপ ফুটবল দল হঠাৎ করে জ্বলে উঠলো, নেপালকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে গেলো, এটাও কী ভাগ্যের জোরে। না, মোটেই তা নয়। ভালো খেলেই সাফের ফাইনালে উঠে গেছে মালদ্বীপ। আমার ধারণা, মালদ্বীপের খেলোয়াড়রা তাদের কোচের প্রতি অবজ্ঞার বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। তাদের অযোগ্যতার কারণে কোচ কেন দায়ী হবে? হয়তো তারা কোচের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যই নিজেদের বদলে ফেলেছে। আহারে! আমাদের জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়রাও তো এমনটা ভাবতে পারতো। অনেক দিন পর একটা সুযোগ এসেছে। সাফ ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের এই তো সময়। সাফ-এ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারলে আমাদের ফুটবল বোধকরি আবার জেগে উঠতো। কোচ খুশি হতেন। দেশের মানুষ খুশি হতেন। ফুটবলের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই একটা জাগরণ দেখা দিতো। কিন্তু সেটা হলো না। বলা যায় বাংলাদেশ ফুটবল দলের গোলকিপারের শিশুসুলভ ভুলের কারণে বাংলাদেশ ফুটবল দল সাফ টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছে। যদিও আমাদের ফুটবল কোচ এটাকে ভুল বলতে নারাজ। বরং তিনি গোলকিপারের পক্ষেই কথা বলেছেন– ‘ফুটবলে এমনই হয়। এজন্য কাউকে দোষারোপ করা ঠিক নয়।’ একজন যোগ্য অভিভাবকের মতো কথা। কিন্তু তিনি ‘উলু বনে মুক্তো’ ছড়াচ্ছেন না তো?
অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন হঠাৎ ফুটবল নিয়ে এত কথা বলার কী আছে? এদেশে ফুটবল আছে নাকি? তাদের উদ্দেশে বিনীতভাবে বলি, এই দেশে একসময় ফুটবলই সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিল। ‘ফুটবলে আছি ফুটবলেই বাঁচি’ এমনই ছিল পরিবেশ। নানা কারণে ফুটবলের সেই ঐতিহ্য নেই। কিন্তু দেশের মানুষ এখনও ফুটবল বলতেই পাগল। তার প্রমাণ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে আবার হাজার-হাজার দর্শকের সমাগম। সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ পর পর দুটি খেলায় ভুটান ও পাকিস্তানকে হারানোর পর দেশের ফুটবলপ্রেমী মানুষের মনে ফুটবল নিয়ে নতুন করে প্রেরণার সঞ্চার হয়েছিল। তারা ভেবেছিল ফুটবলে আবার জমবে মেলা, হাটখোলা। কিন্তু আশার গুড়েবালি। চরম ব্যর্থতায় আবার ঢেকে গেলো বাংলাদেশের ফুটবলের নীল আকাশ। বলা যায় তীরে এসেই তরী ডুবে গেলো!
আবার মালদ্বীপ ফুটবল দলের কথায় আসি। ভাবুন তো একবার, যাদের খালি হাতে দেশে ফিরে যাওয়ার কথা তারাই বোধকরি ফাইনাল ট্রফিটা হাতে নিয়ে দেশে ফিরে যাবে। আর বাংলাদেশ পর পর দুই খেলায় জিতেও টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিলো। তার মানে কী? বাংলাদেশের চেয়ে মালদ্বীপ যোগ্যতর দল? হ্যাঁ, বাস্তবতা তো তা-ই বলে। হিসাবের খাতায় বাংলাদেশের চেয়ে মালদ্বীপই তো যোগ্যতর দল। বাংলাদেশ কেন ফুটবলে যোগ্যতর দল হতে পারছে না? এই মালদ্বীপকেই তো তারা হারিয়েছিল। আবার বাংলাদেশ যে নেপাল দলের কাছে হেরে গেলো, মালদ্বীপ সেই নেপাল দলকেই ৩-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে উঠলো। এটা কি করে সম্ভব? প্রশ্নটা অনেক কঠিন। তবে এর সহজ উত্তরও আছে। উত্তর দেওয়ার আগে কচ্ছ্প আর খরগোশের সেই গল্পটা মনে করিয়ে দিতে চাই। কচ্ছপের ধীরগতিতে হাঁটা দেখে খরগোশ দৌড়াতে গিয়ে হঠাৎ একটু জিরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবে। সে ঘুমিয়ে পড়ে। এই সুযোগে কচ্ছপ খরগোশের আগেই গন্তব্যে পৌঁছে যায়। বোধকরি বাংলাদেশ ফুটবল দলের অবস্থা হয়েছে খরগোশের মতো। সাফ টুর্নামেন্টে পর পর দুই ম্যাচ জিতে এতটাই নির্ভার ছিল যে ভেবেই নিয়েছিল ফাইনালে চলে যাবে। ফলে ঘুমিয়ে নেওয়ার মানসিকতা কাজ করেছে। এই সুযোগে প্রতিপক্ষরা টেক্কা মেরেছে।
এবার সাফ ফুটবলকে ঘিরে দেশের ফুটবলপ্রেমী মানুষের মাঝে একটা জাগরণ দেখা দিয়েছিল। পারিবারিকভাবে অনেক দর্শক বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ দলের খেলা দেখতে গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ দলের ব্যর্থতায় তারা হতাশ। শোনা যাচ্ছে সাফ ব্যর্থতার বিষয় তদন্ত করবেন ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। টানা চারটি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল। কেন বারবার ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ? এ ব্যাপারে নিজেই তদন্তে নামবেন বলে জানিয়েছেন কাজী সালাউদ্দিন।
জানি না এই তদন্তের ফলাফল কী হবে? তবে বাংলাদেশের
ফুটবলকে জাগিয়ে তুলতে হলে তৃণমূল পর্যায়ে নজর দেওয়া বেশ জরুরি। স্কুল, কলেজ পর্যায়ে ফুটবলের তেমন কোনও চর্চা হয় না বললেই চলে। একসময় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দেশে ফুটবল চর্চার ভালো পরিবেশ ছিল। এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও ফুটবলের চর্চা হয় না বললেই চলে। তাহলে নতুন খেলোয়াড় সৃষ্টি হবে কী করে? একসময় দেশের জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। যেমন ঢাকা লীগ, চট্টগ্রাম লীগ, রাজশাহী লীগ। এখন হয় না। প্রেসিডেন্ট কাপ, আগাখান গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টসহ ফুটবলের ক্ষেত্রে অনেক বড় বড় টুর্নামেন্টের আয়োজন থাকতো বছরজুড়ে। এখন এসব টুর্নামেন্ট হয় না। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, একসময় জাতীয় দলের নামকরা ফুটবলারদের খেলা দেখার জন্য মাঠে ছুটে যেতেন দর্শক। অর্থাৎ খেলোয়াড়ের নামের টানেই ফুটবল জনপ্রিয় হতো। এখন জাতীয় দলের অধিকাংশ ফুটবলারকেই দর্শক চেনেন না। এ ব্যাপারে ফেডারেশন পর্যায়েও কোনও উদ্যোগ নেই। জাতীয় দলের ফুটবলাররা তারকা হয়ে উঠতে না পারলে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়ে না, বরং কমে। এ কথা সত্য, ফুটবলাররা যখন তারকার মর্যাদা পান তখন ফুটবলও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের জাতীয় দলে কোনও ফুটবলার সেভাবে তারকা হতে পারেননি। এর দায়ভার কার? ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল অংশ নেবে। কিন্তু এই কি তার নমুনা। সাফে যারা ব্যর্থ হয় তারা বিশ্বকাপে খেলার কথা চিন্তা করে কীভাবে? ব্যাপারটা হাস্যকর নয়কি?
বিনীতভাবে বলি, ফুটবলের ক্ষেত্রে একটা জাগরণ দরকার। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি। তৃণমূল থেকে খেলোয়াড় তৈরি করার উদ্যোগ নিতে হবে। একটা সত্য ঘটনা বলি। পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের একজন অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের নাম মুহাম্মদ আদিল। তিনি একসময় ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে করে আখ ও অন্যান্য ফলমূল বিক্রি করতেন। তাকে জাতীয় দলে খুঁজে নিয়েছে তার দেশ। আছে কি আমাদের দেশে প্রতিভা খোঁজার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনও দৃষ্টান্ত? তবু ফুটবলের জয় হোক।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো