বিজেপি ও ত্রিপুরার বিপ্লব

আহসান কবিরভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দে ‘উল্টাপাল্টা’ মন্তব্যের কারণে ইতোমধ্যে ব্যাপক ‘খ্যাতি’ অর্জন করেছেন। তার সবশেষ মন্তব্য পরিবেশ বিজ্ঞানীদের নজর কেড়েছে। ত্রিপুরার রুদ্র সাগরে একটা নৌকা প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানে বিপ্লব কুমার বলেছেন–হাঁস যখন জলে সাতার কাটে, তখন ওই জলাশয়ে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে যায়। অক্সিজেন বাড়ার ফলে মাছের সংখ্যাও বেড়ে যায়! এরপর বিপ্লব সাহেব ঘোষণা দেন–মাছের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য আমি পঞ্চাশ হাজার সাদা হাঁস মৎস্যজীবীদের হাতে তুলে দেবো! বিপ্লব কুমারের কথা শুনে বিজ্ঞানীরা সাদা হাঁস, সাঁতার, অক্সিজেন আর মাছ বিষয়ক নতুন কোনও গবেষণায় মেতে উঠবেন কিনা, তা এখনও জানা যায়নি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও এই বিপ্লব কুমার জব্বর একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তিনি ব্রিটিশবিরোধিতা করতে গিয়ে নোবেল পুরস্কার বর্জন করেছিলেন। পরে অবশ্য বিপ্লব কুমারকে জানানো হয় যে, জালিওয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর রবীন্দ্রনাথ নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন, নোবেল বর্জন করেননি। এই বক্তব্যের কারণে বিপ্লব ক্ষমা চেয়েছেন কিনা, তা জানা যায়নি।
বিপ্লব কুমারের অক্সিজেন বা রবীন্দ্রতত্ত্বের কথায় একটু পরে আসা যাবে। তার দল বিজেপি আসলে ভারতে কী করতে চাচ্ছে?

বিজেপি ও সমমনা দলগুলো ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে এখনও উগ্র মতবাদই প্রচার করে আসছে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সরকারগুলো প্রথম থেকেই উগ্রবাদী হিন্দুদের তোষণের নীতি নিয়ে পথ হেঁটেছিল তাদের বিশাল ভোট ব্যাংকের কারণে। ২০১৪ সালে ভারত তোলপাড় করা এক রিপোর্টে একথা প্রচারিত হয়েছিল যে, বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনা ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও থেকে শুরু করে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা কল্যাণ সিং এমনকি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও জানতেন। বাবরি মসজিদ ভাঙা ঠেকাতে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বরং ভারতের কংগ্রেস সরকার তখন বিজেপি নেতাদের নীরব সমর্থন দিয়েছিল। আজ সেই বিজেপির কাছেই ক্রমাগত হারছে কংগ্রেস। ত্রিপুরাতে বিজেপির বিজয়ের প্রধান তিনটি কারণের একটি হচ্ছে স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের বিজেপিতে যোগদান!

যাইহোক বিজেপি এখন ভারতের সব রাজ্যে ‘বিদেশি খেদাও’ নিয়ে ঝড় তুলতে চাইছে। এসব রাজ্যের নেতাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বিদেশিদের তালিকা তৈরি করতে। তালিকায় যেসব কথিত বিদেশির নাম উঠবে, প্রথমে তাদের চিহ্নিত করে খবর নেওয়া হবে। লক্ষ রাখা হবে, তারা যেন নিজ বা অন্য রাজ্যে গিয়ে অন্য কোনও ভারতীয় নাগরিকের সুযোগ সুবিধা হরণ করতে না পারে। এরপর এসব কথিত বিদেশিকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে। সবশেষ নির্দেশটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

বিজেপি ক্ষমতায় থাকলেও কথিত বিদেশিদের ব্যাপারে দল ও সরকারের ভূমিকা এখন পর্যন্ত আলাদা যা রহস্যের সৃষ্টি করেছে। বিজেপি দলগতভাবে এতকিছু করলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘বিদেশি খেদাও’ প্রসঙ্গে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথও কিছু বলেননি। সরকারিভাবে ভারত বলছে না যে, তারা অনাগরিক কিংবা কথিত বিদেশিদের ফেরত পাঠাবে। এখন পর্যন্ত তাই আসামসহ বিভিন্ন রাজ্যে যা ঘটছে, তা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তারপরও দলগতভাবে বিজেপির এই বিদেশি ‘খেদাও আন্দোলন’ দীর্ঘস্থায়ী এক রোগের জন্ম দিচ্ছে। এই রোগে ভুগবে বাংলাদেশ ও ভারত। তবে বাংলাদেশের ওপর দিয়েই এই রোগের প্রকোপ বেশি যাবে বলেই মনে হচ্ছে।সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা অশুভ ছায়া তৈরি করতে যাচ্ছে বিজেপি!

২০১৪ সালে বাবরি মসজিদ নিয়ে রিপোর্ট বের হওয়ার পর বিজেপি প্রচার করেছিল এটা কংগ্রেসের কাজ। আগামী বছরের নির্বাচনকে সামনে রেখেই বিজেপি এই ‘বিদেশি খেদাও’ নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। এর কারণ একটাই। কথিত বিদেশি বা অনাগরিকদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া। বিদেশি বলতে মূলত বাংলাভাষাভাষী মুসলমানদেরই বোঝানো হচ্ছে। আসামে কথিত বিদেশিদের যে তালিকা করা হয়েছিল, তাতে হিন্দু ও মুসলমান—দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই নাম ছিল। পরে দেখা গেলো শুধু বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদেরই এই সংকটে ফেলার পাঁয়তারা হচ্ছে। খুব কমসংখ্যক মুসলমান আছেন, যারা মিয়ানমার (রোহিঙ্গা) বা পাকিস্তান থেকে ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান থেকে ভারতে গিয়ে থেকে গেছেন। ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে এটা করলেও বিজেপি চাচ্ছে সংখ্যালঘুরা তাদের ভোট দিক কিংবা ভোটদানে বিরত থাকুক। ত্রিপুরাতে বিজেপির এই ভীতি ছড়ানো ভোটযুদ্ধে কাজে লেগেছিল। আগামী বছরেও (২০১৯) বিজেপি ক্ষমতায় আসতে চায়। যদি আগামী নির্বাচনে জিতে যায় বিজেপি তাহলে বিদেশি খেদাও নিয়ে তারা বাড়াবাড়ি নাও করতে পারে!

বিজেপির ধর্ম বিদ্বেষের মূলমন্ত্র আর পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ধর্মাশ্রিত রাজনৈতিক দলগুলোর মূলমন্ত্র একই। পাকিস্তান আমল থেকেই যারা মুক্তবুদ্ধির মানুষ ছিলেন, তাদের দেখা হতো ধর্মবিরোধী তথা রাষ্ট্রবিরোধিতার চশমায়। মুক্তিযোদ্ধাদের বলা হতো দুষ্কৃতকারী, ভারতীয় অনুচর। কেউ পাকিস্তানিজান্তার বিরোধিতা করলেই হয়ে যেতেন দেশদ্রোহী তথা ভারতের দালাল। ভারতে কেউ এখন বিজেপির বিরোধিতা করলেই তার ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে তাদের পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। কারণ, বিজেপিবিরোধীরা নাকি আসলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের দালালি। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা কেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করে থাকেন আর মমতা কেন গরু খান, মুসলমানদের জনসভায় গিয়ে কলমা পড়ে শোনান, কেন মন্দির পরিচালনা কমিটিতে মুসলমানদের রাখেন, এসব কারণে মমতা সম্পর্কে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দের মন্তব্য–ওনার (মমতা) মাথায় সমস্যা আছে। উনি মানসিক হাসপাতালেও যেতে পারেন অথবা শান্তির জন্য মন্দিরেও সময় কাটাতে পারেন!

লেখাটা শুরু করেছিলাম বিপ্লব কুমারের কথা দিয়ে। শেষ করি তার বচন অমৃত শুনে। বিজেপির সব মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লবের মতো নন। বিপ্লব তার নিজের মতো। তাই সরকারি কর্মচারীদের অফিসে জিন্স ও টি-শার্ট পরে আসতে নিষেধ করেছেন। সানগ্লাস পরতেও মানা করে দিয়েছেন। সরকারি কোনও কাজ যেখানে নেতা-মন্ত্রীরা আসেন, সেখানে কর্মচারীদের মোবাইল ব্যবহার করতেও মানা করে দিয়েছেন। সম্মানিত ব্যক্তিদের সামনে মোবাইল ব্যবহার করলে নাকি তাদের অসম্মান করা হয়। ত্রিপুরার এয়ারপোর্টটা ত্রিপুরার মহারাজা বিক্রম কিশোর আদিত্যের নামে করার উদ্যোগ নেওয়া হলে বিপ্লব কুমার বলেন–রাজাদের আমলেই দেশে ভালো গণতন্ত্র ছিল। তাদের কীর্তি ভোলানোর জন্যই ত্রিপুরায় লেনিন স্ট্যালিনের নাম বলা হতো। তাদের কারা চেনে? কেউ চেনে না। ত্রিপুরাবাসীর উচিত, রাজার ছবি ঘরে রাখা। এরপর বিজেপির সমালোচনা ও বিরোধিতা যারা করে, তাদের উদ্দেশে হুমকি দিয়ে বলেন–মনে রাখতে হবে এটা বিপ্লব কুমার দের সরকার। বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে লাগলে নখ তুলে ফেলবো।

এই দেশের জামায়াত-শিবিরের রগ কাটার কুখ্যাতি ছিল। বিজেপির আসল  চেহারাও এই নখ তুলে নেওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে!

লেখক: রম্যলেখক