তারপরও ‘ঘুম ভাঙা শহরে’ সকাল হবে

আহসান কবিরঅশ্রু গোপন করা কান্নার চেয়েও বেশি কষ্টের। কারণ, কান্না দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করা যায়, বুকে চাপা কষ্টটা চোখের জলে ভাসিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু অশ্রু গোপন করতে গেলে সেটা ভারী পাথর হয়ে জমে থাকে বুকে। এই ‘পাথরচাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্টটা তিনি বুক থেকে নামাতে পারেননি। ‘ফেরারী মনটা’ নিয়ে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। অথচ তিনি এই কষ্টের কাজটাই করতে বলেছিলেন অনেকদিন আগে। বলেছিলেন— ‘এই রূপালি গিটার ফেলে একদিন চলে যাবো দূরে বহুদূরে/ সেদিন চোখে অশ্রু তুমি রেখো গোপন করে!’
আইয়ুব বাচ্চুর ফেলে যাওয়া রূপালি গিটারে কেউ কান্নার সুর তুলছে। বাচ্চু ভাই, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?
গানকে তিনি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন স্বপ্নের রূপালি জগতে। গিটার কখনও রূপালি হতে পারে, হতে পারে অনেক যুবকের স্বপ্নের জগৎ, সেটা আইয়ুব বাচ্চুর গিটার বাজানো দেখলেই মনে হতো। তাঁর গিটারের ঝংকারে মোহাবিষ্ট হতো মানুষ, তখন তাঁর হাতের গিটারকে রূপালিই মনে হতো। হয়তো গিটার বাজাতে বাজাতেই একদিন তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন মানুষের আসল ঠিকানা। বহু মানুষ তাঁর সেই গানের আনন্দে ভেসেছে। কিন্তু কখনও ভাবতে চায়নি সেই গানের কথাই চিরসত্য। ‘ঠিকানা শুধু এক সমাধি সাড়ে তিন হাত মাটি’!

এই সাড়ে তিন হাত সমাধি থেকে তিনি কোনও একদিন ‘তারা ভরা রাতে’ ফিরে যেতে চাইবেন সেই ‘রক্ত গোলাপে’র কাছে। যেতে চাইবেন ‘ময়না’র কাছে। ময়নার সঙ্গে দেখা না হলে হয়তো বহুদিন পরে তার কথা মনে রেখে অশ্রু গোপন করে হাতে গিটার নিয়ে বসবেন সুর করতে। গিটারের ঝংকারে বাজবে সেই অনবদ্য সুর— ‘আলো ভেবে যারে আমি জীবনে জড়াতে চাই, সে তো আলো নয় যেন আলেয়া। নির্জনে আমি শুধু আঁধারে হারিয়ে যাই! (গায়ক তপন চৌধুরীর জন্য এই গানটি সুর করেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। এমন অনেক জনপ্রিয় গানের সুরকার আইয়ুব বাচ্চু)

গানের জগতে তিনি হারিয়ে যেতে আসেননি। জন্মেছিলেন সাগর পাড়ের জেলা চট্টগ্রামে (১৬ আগস্ট, ১৯৬২)। স্কুল জীবনেই জড়িয়ে পড়েছিলেন গানের সঙ্গে। গিটার নিয়ে সারা রাত বাজাতেন, ঘুমুতেন সকালে। সাগর পাড়ে গিয়ে সাগরের ঢেউয়ের শব্দ তুলতেন গিটারে। কখনও শান্ত ঢেউ কিংবা কখনও সর্বগ্রাসী ঢেউয়ের আছড়ে পড়া শব্দটাকে তুলতে চাইতেন তাঁর হাতের রূপালি গিটারে! ১৯৭৭-৭৮ সালে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিন বছর পরে যোগ দেন ব্যান্ডদল সোলসের সঙ্গে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সোলসের সঙ্গেই ছিলেন। সোলসে থাকা অবস্থায়ই আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম অ্যালবাম বের হয় যার নাম ‘রক্তগোলাপ’। দ্বিতীয় অ্যালবামের নাম ছিল ‘ময়না’। ময়না গানটা তাঁকে প্রথম গায়ক হিসেবে অনেক পরিচিতি এনে দেয়।

আজীবন অভিমানী ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। বলতেন— ১৯৮৬ সালে পাঁচ ছয়শ টাকা পকেটে নিয়ে খুব অভিমানে নীরবেই চলে এসেছিলাম ঢাকায়। উঠেছিলাম সোলস ব্যান্ডের সদস্যরা ঢাকা এলে যে হোটেলে উঠতেন, সেই হোটেলে (এলিফেন্ট রোডের ব্লু নাইল হোটেল) গিটার আর সংগীত ছিল তার অভিমান প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম। যদিও গানে গানে সেটা অস্বীকার করতেন। তার জনপ্রিয় একটা গানের কথা এমন— কোনও অভিযোগ নেই যে আমার কোনও অভিমান নেই এখন! তবে অভিমানটা অনেক সময় বলে দিতেন সরাসরি। হয়তো আবদুন নুর তুষার তাঁর শুভেচ্ছা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের শুরুর দিকে আইয়ুব বাচ্চুর ব্যান্ডকে নেননি, নিয়েছিলেন নামকরা আরেক ব্যান্ডকে। বাচ্চু ভাই পরে তুষারকে বলেছিলেন— চাটগাইয়া পোলা খুব একটা ইংরেজি বলতে পারি না! তুষার এর পরে শুভেচ্ছার অনেকগুলো পর্বে বাচ্চু ভাইকে নিয়েছিলেন। আবদুন নুর তুষার একবার গিয়েছিলেন জাপান, ইতালি আর দুবাইতে অনুষ্ঠান করতে। সঙ্গে বাচ্চু ভাইও ছিলেন। জাপানে এক গিটারের দোকানে গিয়েছিলেন তারা। জাপানি সেই দোকানি বাচ্চু ভাইকে পাত্তাই দেয়নি। সে কথা বলছিল অন্য এক লোকের সঙ্গে। পারমিশন নিয়ে বাচ্চু ভাই গিটার বাজানো শুরু করলেন। নাফলার ব্রাদার্স, জিমি হেনড্রিকস আর সান্টানার সুর তুললেন। এরপর এরিক ক্লাপটন। দোকানের সামনে ভিড় জমে গেল। বাচ্চু ভাই সবাইকে সাক্ষী রেখে গিটারে তুললেন সেই অমর সুর- ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।

বাচ্চু ভাইয়ের চলে যাবার সংবাদ শুনে আবদুন নুর তুষার তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে একথা জানিয়েছেন।

অভিমান ছিল তার ময়নার সঙ্গেও। খুব অভিমান করে গেয়েছিলেন— ময়না, এখনও আমার জন্য রাত্রি জাগে না/কবিতার লাইন চুরি করে চিঠি লেখে না। কবিতার লাইন চুরি করে লেখার ভেতর যে প্রেম, এই মোবাইলের যুগে সেটা কেউ অনুধাবনই করতে পারবে না। অনুধাবন করতে পারবে না ফরেস্ট হিলের এক দুপুরে কারও প্রতীক্ষায় থাকা কতটা কষ্টের। এই কষ্ট নিয়েই এসেছিলেন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায়। আইয়ুব বাচ্চুর জন্য সেটা ছিল জীবনযুদ্ধের এক কঠিনতম সময়। কখনও হোটেলে গিটার বাজিয়ে একাই গান গাইতে হয়েছে। হয়েছে খুব সামান্য টাকায় গান করতে। কখনও হাত ভেঙে গিয়েছে। ভাঙা হাতের তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে গান গেয়ে তারপর স্টেজ থেকে নামতে হয়েছে। ১৯৯০ সালে সোলস থেকে বের হওয়ার পর ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের প্রথম ‘ডাবল অ্যালবাম’ বের করলেন আইয়ুব বাচ্চু। ব্যান্ডের নাম এলআরবি। প্রথমে এলআরবি ছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। পরে নাম ঠিক রেখে পূর্ণরূপ বদলে ফেলেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। এলআরবির পূর্ণরূপ করেছিলেন— লাভ রানস ব্লাইন্ড।

হয়তো ভালোবাসা অন্ধ। বাচ্চু ভাই নিজের প্রতিও আপনি ছিলেন তুমুল অন্ধ। ভালোবেসেছিলেন এলআরবির দলের সব সদস্যদের। গর্ব করে বলতেন আমরা এলআরবিকে রেখে যাবো, আমাদের পরের প্রজন্ম এটার হাল ধরবে। ছেলেকে নিয়েও এক-দুইটা শো করেছিলেন আপনি। মাঝে গায়ক এস আই টুটুল দল ছাড়লে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। এস আই টুটুল দল ছাড়ার পরে কি-বোর্ড বাজানোর জন্য আর কাউকে দলে নেননি। ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর নিজের বাসায় বসে যখন হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন, তখন আপনার ছেলে এবং মেয়ে দুজনই বিদেশে। বাচ্চু ভাই আপনার নিজের লেখা, সুর করা, গাওয়া এবং সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় গান, সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’র লাইন— আমার অপরাধ ছিল যতটুকু তোমার কাছে/তুমি ক্ষমা করে দিও আমায়। বাচ্চু ভাই, আপনার নিজের প্রতি অভিমান আর অবহেলাটার কোনও ক্ষমা নেই।

২০০৯ সালে হার্টে রিং পরানো হয়েছিল আপনার। আপনি অশ্রু গোপন করার মতো সেটা গোপন রেখেছিলেন। ২০১২ সালের শেষে ফুসফুসে পানি জমেছিল। আপনি খানিক ভালো হয়ে আবার নেমে পড়েছিলেন রূপালি গিটার নিয়ে। ২০১৪ সালে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। গোপন রেখে আবারও নামেন গানের হাতছানিতে। ১৬ অক্টোবর (২০১৮) সর্বশেষ শো করেছিলেন রংপুরে। ফেরার পথে বিমানে পুরোটা সময় ঘুমিয়েছেন। আপনার কি তখনও মনে হয়নি আমাদের জন্য আরও বেশি কিছুটা সময় আপনার বেঁচে থাকা দরকার? কখনও কি মনে হয়নি আপনার ছেলে আর মেয়েটার জন্য আপনার অল্প কয়েকটা দিন পৃথিবীতে বেশি থাকা দরকার? কখনও কি মনে হয়নি আপনার— যে যায় সে একা হয়তো যায়, কিন্তু সঙ্গে করে নিয়ে যায় আমাদের স্মৃতি কিংবা আত্মার অংশ? নাকি যার প্রতি আলমেটাম দিয়েছিলেন সে আপনাকে আরও বেশি কাঁদিয়েছিল? তাই কি উড়াল দিলেন আকাশে?

বাচ্চু ভাই তারপরও ‘ঘুম ভাঙা শহরে’ সকাল হবে। ‘হকার’ ছেলেটা পেটের দায়ে পেপার পেপার বলে রাস্তায় নামবে। সন্ধ্যার পর ‘মাধবী’রা নামবে রাস্তায়। সেই মাধবী, যাকে যে চায় সে পায়! তবু ব্যান্ড সংগীতের সেই উত্তাল দিনগুলোতে ক্যাপ পরা গিটার হাতে স্মার্টলি আপনার বাজানো স্মৃতি থেকে কখনও যাবে না। না পাওয়ার বেদনা, স্বজন হারানোর কষ্ট, বাবা-মার মৃত্যু, পরাজয়ের বেদনা সইতে যে ছেলেটা গিটার হাতে নিয়ে বসবে, তার আজম খান কিংবা লাকি আখান্দ এর মতো আপনার কথাও মনে পড়বে। কেউ হয়তো একাত্তর সালে ‘সাবিত্রী রায়’ কেন দেশত্যাগ করেছিল সেটা ভাববে। তারা ভরা রাতে কেউ ময়নাকে বোঝানোর চেষ্টা করবে। দরোজার ওপাশে নিজ ভুবনে চিরদুঃখী মানুষটার কষ্ট বোঝার চেষ্টা করবে। কেউ এক আকাশ তারা গোনার জন্য তার প্রিয়তমাকে আহ্বান জানাবে। কেউ ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ’র আড়ালে হাসি শেষের নীরবতাটা অনুভব করার চেষ্টা করবে। কেউ ‘শেষ কবে বৃষ্টিতে করেছিলে স্নান- মনে আছে নাকি নাই’এর হিসেব কষবে। আইয়ুব বাচ্চুর রূপালি গিটার ছড়িয়ে যাবে সারা বাংলাদেশে!

বাচ্চু ভাই, জানালা বন্ধ করে দরোজার ওপাশে নিজেকে যতই আড়াল করেন, আপনার জন্য বুকের ভেতর ভালোবাসার যে রোদ্দুর, সেটা চিরকাল একরকমই থাকবে। আপনি চলে যাওয়ার পর আমাদের কান্নাটা আপনি দেখলেন না।

বাচ্চু ভাই, আপনার রূপালি গিটারে কেউ এখন কান্নার সুর তুলছে। আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?

লেখক: রম্যলেখক