মোদির ‘আচ্ছে দিন’ বিক্রির দিন শেষ


বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীফ্রান্স থেকে রাফায়েল বিমান ক্রয় নিয়ে সম্ভবত ধীরে ধীরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বড় এক আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছেন। রাফায়েল বিমান ক্রয় সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মোট চারটি মামলা হয়েছে। সবক’টি মামলার একসঙ্গে শুনানি চলছে। এ চারটি মামলার মধ্যে একটি মামলা করেছেন বিজেপির সাবেক নেতা যশবন্ত সিনহা ও অরুণ শৌরি।




অটল বিহারি বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন যশবন্ত সিনহা তার মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী ছিলেন। অরুণ শৌরিও বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার সদস্য। ক’দিন আগে প্রধান বিচারপতি অবসরে গেছেন। তার বিরুদ্ধে চারজন বিচারপতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে এটা ছিল স্বাধীনতার পর নজিরবিহীন ঘটনা। সেই চারজন বিচারপতির জ্যেষ্ঠ বিচারপতি রঞ্জন গগৈ বর্তমান ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। তিনি সুপ্রিম কোর্টে গেছেন আসাম হাইকোর্ট থেকে।
গত ৩১ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি নির্দেশ জারি করেছেন ১০ দিনের মধ্যে রাফায়েল যুদ্ধবিমানের মূল্য নিরূপণ সম্পর্কীয় নথিপত্র মুখবন্ধ খামে সুপ্রিম কোর্ট সমীপে জমা দিতে। শুধু তা-ই নয়, সুপ্রিম কোর্ট জানতে চেয়েছেন শিল্পপতি অনিল আম্বানী রাফায়েল যুদ্ধবিমান ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়ে কীভাবে সম্পৃক্ত হলেন তার বিস্তারিত লিখিত ব্যাখ্যা দিতে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে ভেনু গোপাল এ নির্দেশের আপত্তি জানিয়ে বলেছেন, রাফায়েলের সঙ্গে দাম সংক্রান্ত বিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষার চুক্তি রয়েছে। বিষয়টি নাকি স্পর্শকাতরও। এসব তথ্য গোপনীয়, প্রকাশ করা যাবে না। সে কথা শুনে প্রধান বিচারপতি গগৈ বলেছেন, সরকার এ কথাগুলো হলফনামায় লিখে জমা দিক এবং জানাক কেন বিষয়টা গোপনীয়।
বিরোধী দল কংগ্রেস দাবি করছে, কত দামে কয়টা রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনা হচ্ছে তা কখনও গোপনীয় বিষয় হতে পারে না। অনিল আম্বানী সম্পর্কে সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, অনিল আম্বানীর সম্পৃক্ততা সম্পর্কে সরকারের কোনও ভূমিকা নেই। অথচ ফ্রান্সের আগের প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট স্বীকার করেছেন অনিল আম্বানীর সম্পৃক্ততা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইচ্ছানুসারে হয়েছে।
বিষয়টা শুনানির পর অরুণ শৌরি বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের পদক্ষেপ খুবই জরুরি। কারণ, নিরাপত্তার সঙ্গে দামের কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে না। গত ১১ সেপ্টেম্বর অ্যাডভোকেট প্রশান্ত ভূষণ, যিনি সুপ্রিম কোর্টে যশোবন্ত সিনহা এবং অরুণ শৌরির পক্ষ হয়ে মামলা পরিচালনা করেছেন, দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলন করে রাফায়েল বিষয়ে বিস্তারিত বলছেন। রাফায়েল ক্রয়ের বিষয় নিয়ে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে তার আক্রমণের সুর আরও চড়িয়েছেন। ২ নভেম্বর ২০১৮ রাহুল গান্ধী শুধু কথা বলেননি, কংগ্রেস কর্মীদের নিয়ে বিক্ষোভেও সরব ছিলেন। রাহুল বলেছেন, দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সিবিআই প্রধান আলোক বর্মাকে জোর করে ছুটিতে পাঠিয়েছেন। লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা মল্লিকা অর্জুন এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন।
সিবিআই শাসনতান্ত্রিক সংস্থা। তার অ্যাপোয়েন্টিং ও কট্রোলিং বডি হচ্ছে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটা কমিটি। আর এ তিন সদস্য হচ্ছেন (১) প্রধানমন্ত্রী (২) প্রধান বিচারপতি (৩) লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা। কাউকে কিছু অবগত না করে সিবিআই প্রধান আলোক বর্মা এবং উপ-প্রধান রাকেশ আস্থানকে ছুটিতে পাঠানোর নির্দেশ জারি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এটা সরকার করতে পারে না। মল্লিকা অর্জুনের মামলাসহ মোট চারটি মামলা হলো রাফায়েল যুদ্ধবিমান সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে।
এ মাসে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, মনিপুরে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন। মনিপুর ছাড়া অন্য তিন রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায়। রাফায়েল কেলেঙ্কারি বিজেপিকে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। আবার ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে লোকসভা নির্বাচনও দ্রুত এগিয়ে আসছে। রাজিব গান্ধীর বিরুদ্ধে বফোর্স কামান কেলেঙ্কারির কথা উঠেছিল অনুরূপ এক লোকসভা নির্বাচনের আগে। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের জনতা জোট এবং বিজেপি নির্বাচনের সময়ে স্লোগান তুলেছিলো ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়’। এই এক স্লোগানই রাজিবের নিশ্চিত বিজয়কে ঠেকিয়ে দিয়েছিল। জনতা জোট বিজেপির সমর্থনে সরকার গঠন করলো। কংগ্রেস পেল ১৭০ সিট। আর যে বিজেপির লোকসভায় দুই সিট ছিল গোবলয়ে, জনতা জোটের সঙ্গে সিট অ্যারেজমেন্ট করে একটানে উঠে গেল ৮৬ সিটে। বিজেপির সে যাত্রা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
তবে এবারের রাফায়েল যুদ্ধবিমান ক্রয়ে নরেন্দ্র মোদি যে কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন এবং সুপ্রিম কোর্টে যেভাবে মামলা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে যে তার অবস্থা রাজিবের মতো হওয়া বিচিত্র নয়। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মনমোহনের মতো সৎ প্রধানমন্ত্রীর ভরাডুবি হয়েছে শুধু তার মন্ত্রীদের দুর্নীতির কারণে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস সিট পেয়েছিল মাত্র ৪০টি। কংগ্রেসের ইতিহাসে সেটা ছিল সর্বনিম্ন সিট পাওয়া। অথচ কয়লা খনির ইজারা প্রদান বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ছিলেন সম্পূর্ণ ইনোসেন্ট আর রাফায়েল যুদ্ধবিমান ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে ভারতীয় বিমানবাহিনী ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকারে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একতরফা ও বেআইনিভাবে নিজেই সবকিছু করেছেন বলে অভিযোগ। দেশরক্ষা বিষয়ক কোনও ক্রয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হলে দেশরক্ষামন্ত্রী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, বাহিনী প্রধান ও বিদেশ মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করতে হয় অথচ রাফায়েল ডিলে তিনি একাই সবকিছু করেছেন আর সবই ছিল অন্ধকারে। নরেন্দ্র মোদি এককভাবে করেছেন বলে যশোবন্ত সিনহা ও অরুণ শৌরি প্রেস কনফারেন্স করে অভিযোগ করেছেন।
কংগ্রেস সভাপতি প্রতিদিনই এ সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করে চলেছেন। বিশিষ্ট ধর্মীয় গুরু রামদেব ঘোষণা করেছেন, তিনি ২০১৪ সালের লোকসভার মতো ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন বিজেপির জন্য কোনও প্রচারণায় অংশগ্রহণ করবেন না। গুরু রামদেব উচ্চশিক্ষিত লোক, তিনি মোদির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা অন্ধের হাতে মোমবাতি দিয়েছি’। শিবসেনা কংগ্রেসের ভারত বন্ধ ডাকে সাড়া দিয়ে মহারাষ্ট্রে পোস্টারিং করেছে অথচ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় তাদের দলের মন্ত্রী রয়েছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশের জনতা দল (ইউনাইটেড), রাম বিলাস পাশওয়ানের রাষ্ট্রীয় লোক সমতা পার্টি, ভারতীয় সমাজ পার্টি (শুয়েল দেব), তারাও বন্ধের পক্ষে কাজ করেছে। পেট্রোল এবং ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যেরও মূল্য বেড়েছে, যে কারণে জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। ২০১৪ সালের মোদির স্লোগান ‘আচ্ছে দিন’ এখন উপহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাফায়েল বিমান ক্রয়ের কাণ্ড নিয়ে আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে মোদির জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোদির পক্ষে ক্ষমতায় ফিরে আসা কঠিন হয়ে উঠছে। রাহুল বলেছেন, নরেন্দ্র মোদি রাফায়েল কেনার ব্যাপারে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা অনিল আম্বানীকে পাইয়ে দিয়েছেন। এ অভিযোগ রাহুল প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে মোদির গ্রহণযোগ্যতার করুণ পরিণতি হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com