তো সেই রাজনীতির প্রতি মোহ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। মনোনয়নের জন্য হামলে পড়া থেকে শুরু করে বড় দুই দলের মনোনয়ন সবই সেই রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ যে রাজনীতির প্রকৃতি ওপরে আলোচনা করলাম। কিন্তু রাজনীতিকের মধ্যেও তো পার্থক্য কিছু ছিল। সবাই একরকম নয়, এমন একটা প্রচারণা ছিল। কিন্তু এবার সেটিও আর দেখা গেলো না। নির্বাচন এলে মনোনয়ন বঞ্চিতদের ডিগবাজির নজির বহুকালের। কিন্তু এবার এমন লোকজন মার্কা বদল করে নির্বাচন করছেন যাদের আমরা রাজনীতিকের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বা সুশীল বলে জানি।
নাগরিক সমাজের নানা আন্দোলনে তারা গণমানুষের প্রতিনিধি হিসেবে থাকেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’কেই তারা প্রধানতম রাজনীতি বলে প্রচার করেন। খেয়াল করা ভালো,দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দাবিটি মূলত নাগরিক সমাজের। নাগরিক সমাজ নামের এক ‘এলিট’ বৃত্তের রাজনীতি করেন এরা। যাদের নামে তারা রাজনীতি করেন, সেই আম জনতার প্রবেশাধিকার নেই তাদের গৃহে, সেই বৃত্তে। অথচ নির্বাচনকে সামনে রেখে চটকদার সব কথা বলে বলে এখন খুনি, দুর্নীতিবাজের রক্ষক হিসেবে এদের মাঠে দেখা যাচ্ছে। এই রাজনীতি মোটেও রাজনীতি নয়, এই রাজনীতি আমজনতার জন্য রাজনীতি নয়, এই রাজনীতি বিশুদ্ধ সুবিধাবাদ।
‘দুর্নীতিমুক্ত সংসদ গড়ে তোলা’র অভিলাষ প্রকাশ করছেন তারা বড় দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে নিয়ে। তারা ভালো করে জানেন, যে রাজনীতি তারা করেন, সেই রাজনীতির সাধ্য নেই সংসদের ধারে কাছে যাওয়ার। রাজনৈতিক সমাজের পরিসরে তাদের কেউ চেনে না। তাদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাবের সঙ্গে মানুষের কোনও সম্পর্ক নেই। নাগরিক সমাজ রাজনৈতিক সমাজের নতুন রাজনীতি করবে বলে যে আশা জাগিয়েছিলেন তা আর দেখছি না আমরা।
এই রাজনীতির সুবিধা এই যে, এক প্রশ্নে অবস্থানের সঙ্গে অন্য প্রশ্নে অবস্থানের আদর্শগত সঙ্গতির কথা এমন রাজনীতিবিদদের ভাবতে হচ্ছে না। মাপকাঠি একটাই দুর্নীতি-বিরোধী ‘জেহাদ’ বা ‘মানুষের ভোটের অধিকার’ ফিরিয়ে আনার নামে ধরে ফেলা যাচ্ছে রাজনৈতিক সমাজকে।
ভোটের রাজনীতির কথা মাথায় রেখে নাগরিক সমাজের নীতি থেকে বিচ্যুতির এগুলো নতুন দৃষ্টান্ত। যে নাগরিক সমাজের মূল দাবি আইনের শাসন, মূলত তারা এখন নাগরিক সমাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত শুধু মার্কা দখল করে নির্বাচন করার জন্য।
এমন বিশুদ্ধ সুবিধাবাদের রাজনীতি সম্পর্কে আসলে আমাদের ধারণা নেই। এটা কি গণতন্ত্রকে আরও একধাপ গভীরে নিয়ে যায়, নাকি নৈরাজ্যের পথে আরও এক পা এগিয়ে দেয়? শুধু নির্বাচনের নামে যেভাবে জঙ্গি, যুদ্ধাপরাধীদের হাতে মনোনয়নের নামে প্রশ্নাতীত ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে, তাকে আবার এই সুশীল রাজনীতিকরা সমর্থন দিচ্ছেন, তা স্বাস্থ্যকর নয়। গণতন্ত্র যে স্তম্ভগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, ভোটের জোয়ারে সেগুলোকে ভাসিয়ে দিতে এই রাজনীতিকদের আপত্তি নেই।
গণতন্ত্র শুধু ভোটদান ও জনপ্রতিনিধিত্বের অধিকার চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। কত শতাংশ ভোট পড়লো বা কোন দল কতটা ভোট পেলো তার চর্চা নিশ্চয়ই জরুরি। কারা কোন কারণে নির্বাচন করছেন, কীভাবে নির্বাচন করছেন, কেন ভোটদাতারা একজনকে পছন্দ করছেন বা করছেন না, তার চর্চা কম মূল্যবান নয়। যারা নির্বাচন করছেন তাদের জনপ্রতিনিধিত্বের যোগ্যতার মাপকাঠি ঠিক কী হবে, তা-ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র শুধুমাত্র সংখ্যার খেলা নয়, আরও গভীরতর মূল্যবান এক যাপনের অঙ্গ হয়ে উঠুক—এটুকু চাওয়া অন্যায় নয়। ঠিক এই জায়গাতেই ব্যর্থ হয়েছেন এসব ছোট দলের বড় নেতারা, যাদের নাগরিক সমাজে ব্যাপক প্রভাব আছে।
গণতন্ত্রের পথে নাগরিক পছন্দ-অপছন্দের দিকটা যেমন দেখা প্রয়োজন, তেমনই দলভিত্তিক গণতন্ত্রে দলের মতাদর্শ বা রাজনীতিগত পছন্দ-অপছন্দ সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রক্রিয়া দুটি পরস্পর নির্ভরশীল। গণতান্ত্রিক কাঠামোর পরিমার্জন কীভাবে হবে তা নিয়ে ভাবনা নেই। উন্নত রাজনীতি দিয়ে সমাজকে নেতৃত্ব দেওয়ার বদলে এক দুর্বৃত্তের বদলে আরেক দুর্বৃত্ত দেশকে নেতৃত্ব দেবে? এটাই রাজনীতি? প্রশ্নটা রইলো। যে ব্যক্তি সমাজ ও রাজনীতির শীর্ষে থেকে অন্যায় করছেন বা প্রশ্রয় দিচ্ছেন তার জনপ্রতিনিধিত্বের কোনও অধিকার নেই। কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্যায় যারা মেনে নিচ্ছেন তারাও কি সমান দাগি নন?
নির্বাচন হবে, একটি সংসদও গঠিত হবে। নাগরিক সমাজের এই রাজনীতিকরা ক্ষমতাসীনদের বিরোধিতা করছেন, ভালো কথা। কিন্তু নির্বাচনের সময়ই, ক্ষমতায় বসার আগেই কিছু লোককে আইনের শাসনের ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়ার এই যে তৎপরতা তা দিয়ে এরা মূলধারার রাজনীতিতে সফল হবেন? ভবিষ্যৎই বলবে। কিন্তু এটুকু বলতে পারি দেশের নাগরিক সমাজের রাজনীতিতে যবনিকা পতন হয়েছে এদের সাম্প্রতিক তৎপরতায়।
লেখক: প্রধান সম্পাদক জিটিভি ও সারাবাংলা