হৃদয়ের সবক’টা জানালা খোলা থাকবে

আহসান কবির‘শিখা চিরন্তন’ যেভাবে চিরদিন জ্বলার ব্রত নিয়ে প্রতিদিনই জ্বলে, ঠিক তেমনই একজোড়া চোখ যদি বাঁচিয়ে রাখা যেত! যদি সারাদেহ মাটি খেয়ে নেওয়ার পরও বেঁচে থাকতে পারতো সেই চোখজোড়া! তাহলে চিরকাল প্রিয়তম মানুষ  কিংবা দেশটাকে দেখার সাধ মিটতো! না দেখতে পাওয়ার অপরিসীম বেদনা নিয়ে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল চলে গেলেন শহীদ নজরুলের কাছে,আনোয়ার কামালের কাছে!
প্রিয় পাঠক, দৃশ্যটা কল্পনা করুন।
জেলে বন্দি ঊনচল্লিশজন মানুষকে (অনেকের মতে এই সংখ্যা সাইত্রিশ, কারও কারও মতে আরও বেশি) নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বধ্যভূমিতে। তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়ের (১৯৭১) ছাত্র নজরুল ইসলাম। তার কাছে কারাগারে বন্দি ক্লাস টেনের ছাত্র আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল জানতে চাইলেন– ‘ভাই, আপনি তো পালিয়ে যেতে পারতেন। পালালেন না কেন?’ গালে চড় মেরে নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা পালিয়ে যেতে শেখেনি। তোরা যারা এখানে থাকবি, মুক্তিযোদ্ধারা তোদের একদিন ফুলের মালা দিয়ে বরণ করবে। আমার এই লুঙ্গিটা আমার মায়ের কাছে পৌঁছে দিস।’ ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগার থেকে তুলে নিয়ে এই ঊনচল্লিশজন মুক্তিকামী মানুষকে পৈরতলা খালে হত্যা করা হয়। এই ঊনচল্লিশজনকে যেদিন বধ্যভূমিতে নেওয়া হয় সেদিন ছিল ঈদ। কিন্তু তাদের জন্য ঈদ কোনও আনন্দ বয়ে আনতে পারেনি।

নজরুল ইসলামকে হয়তো ভুলতে পারেননি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ভুলতে পারেননি শহীদ দারোগা সিরু মিঞা আর তার ছেলে আনোয়ার কামালকে। দারোগা সিরু মিঞা বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের পরিবারকে ভারতে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছিলেন। বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়ার আগে সিরু মিঞা দারোগা তার ছেলে আনোয়ার কামালের জন্য কাঁদছিলেন। গায়ের চাদর দিয়ে তার চোখ মুছে দিচ্ছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। বধ্যভূমিতে নেওয়ার আগে আনোয়ার কামাল বলেছিলেন– ‘বুলবুল আমি কিংবা বাবা কেউ থাকলো না। রাস্তায় কোনও পাগলীকে দেখলে ভাববি সেই-ই হয়তো আমার মা।’

আনোয়ার কামালের স্মৃতির চাদরে আজীবন নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন বুলবুল। তাই কোনও এক সকালে গিটারের ধুন থেকে যে সুর তৈরি হতে পারে সেটা এমন– ‘সেই রেল লাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে/এক মধ্যবয়সী নারী এখনও রয়েছে হাত বাড়িয়ে/খোকা ফিরবে, ঘরে ফিরবে, কবে ফিরবে নাকি ফিরবে না!’

আনোয়ার কামাল, সিরু মিঞা দারোগা কিংবা নজরুলরা ফেরেননি। দেশকে ভালোবাসার ব্যতিক্রম এক ঘোর নিয়ে ফিরেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। যখন যুদ্ধে যান তখন ক্লাস টেনে পড়তেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সকালে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিলেন। মন কেঁদে উঠেছিল মৃত্যুপুরী ঢাকাকে দেখে। তখনই সিদ্ধান্ত নেন প্রতিশোধ নেবেন। লায়লা খালেদ নামের অসম্ভব সাহসী এক নারী ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য বিমান ছিনতাই করে সারা পৃথিবীর গণমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন। আর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল নামের কিশোর ছেলেটা এক বিহারির বাসা থেকে বন্দুক চুরি করেছিলেন। বন্ধুদের নিয়ে সমবেত হয়েছিলেন জিঞ্জিরায়। পাকিস্তানিরা সেখানে হামলা চালায়। স্থান বদলে চলে যান পইট্টায়। এরপর একদিন একাই চলে যান আগরতলা হয়ে মেলাঘরে। ট্রেনিং শেষে কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন।

একাত্তরের অক্টোবরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আগে তন্তুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চেকপোস্টে ধরা পড়েন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। পাঁচদিন তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায় পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আলি রেজার অনুগত হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। পরে তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলে পাঠানো হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলবন্দিদের বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করার হৃদয়বিদারক ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তিনি। আজীবন আগলে রেখেছেন নজরুল ইসলামের লুঙ্গির পরশ কিংবা সিরু মিঞা দারোগার চাদরের ওম! সেজন্য তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল সেই অমর সুর তৈরি করা– ‘সবকটা জানালা খুলে দাওনা/আমি গাইবো গাইবো বিজয়েরই গান/ওরা আসবে চুপি চুপি/যারা এই দেশটাকে/ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ।’

একান্ত আড্ডায় চোখের জল ফেলতে ফেলতে মুক্তিযুদ্ধের এসব দুঃসহ স্মৃতির জানালা খুলে দিতেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ভাবতেন, নজরুল ভাই বেঁচে থাকলে এখন কী করতেন? আনোয়ার কামালের চেহারা কেমন হতো। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সময়ে তিনি নিজে সাক্ষ্য দেন রাজাকারকুলের শিরোমণি গোলাম আজমের বিরুদ্ধে। জানি না এতকিছু করে কী পেয়েছেন। তবে খোকার ফেরার অপেক্ষায় যে মা রেল লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন সেই রেল লাইনের পাশেই তার ভাই মেরাজের গলাকাটা লাশ পাওয়া গিয়েছিল। স্বাধীন দেশে নিরাপত্তার নামে শেষ কয়দিন পরাধীন হয়ে কার্যত নিজ ঘরেই বন্দি ছিলেন!

স্বাধীনতার পর বন্দুক ফেলে গিটার ধরেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। বরেণ্য সুরকার আলম খানের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। কয়েক বছর পরে (১৯৭৭-৭৮) প্রায় একই সময়ে দুটি ছবির সংগীত পরিচালনার কাজ পান। ‘মেঘ বিজলী বাদল’ আর ‘নান্টু ঘটক’। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে “সব ক’টা জানালা খুলে দাওনা” গানের আবেদন ততদিন থাকবে। দেশের যেকোনও ক্রান্তিকালে কখনও ফুরাবে না গানে গানে বলা সেই প্রশ্ন– ‘একাত্তরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তিসেনার দল?’

নতুন প্রজন্মের অগণিত মুক্তিসেনা এই বাংলার কোনও প্রান্তরে কিংবা পৃথিবীর অন্য কোথাও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে আর খুঁজে পাবে না। তবু যে ছেলেটা প্রেমিকার পাশে বসে গেয়ে উঠবে– ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ কিংবা ‘আমার বুকের মধ্যখানে মন যেখানে হৃদয় যেখানে/ সেইখানে তোমাকে আমি রেখেছি কত না যতনে’, সেই ছেলেটা নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলবে মানুষটার জন্য।

কোনও বিয়ের অনুষ্ঠানে যখন ধুমধাম করে বাজবে ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’ তখনও শত মানুষের ভিড়ে হৃদয়ের মগ্নতায় আমাদের মনে পড়বে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের নাম। ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘মাঝি নাও ছাইড়া দে, ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন’, ‘যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে’র মতো মিষ্টি আর রোমন্টিক গানগুলো মানুষ কখনোই ভুলতে পারবে না। ‘ও আমার আট কোটি ফুল দেখো গো মালী’, ‘মাগো আর তোমাকে ঘুমপাড়ানি মাসি হতে দেবো না’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’র মতো দেশাত্মবোধক গান শ্রোতারা কখনও ভুলবে না। দেশাত্মবোধক অথচ ভিন্নধর্মী সুরের গান যে জনপ্রিয় হতে পারে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তা দেখিয়ে গেছেন।

দেশ আর মানুষের জন্য যে প্রেম স্বর্গ থেকে আসে, সেই প্রেমকে পৃথিবীতে অমর করে রেখে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল চলে গেছেন নজরুলের কাছে, আনোয়ার কামালের কাছে। রুমী কিংবা আজাদের কাছে। বদি কিংবা জুয়েলের কাছে। গুলিতে তিন আঙুল হারানোর পরও ক্রিকেট খেলার স্বপ্নটা হারায়নি জুয়েল। হয়তো জুয়েলকে সঙ্গে নিয়ে ফিরবেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। নয়তো ফিরবেন রুমীকে সঙ্গে নিয়ে। নজরুল কিংবা আনোয়ার কামালকে সঙ্গে নিয়ে। অথবা আসবেন আলতাফ মাহমুদকে সঙ্গে নিয়ে।

তারা আসবেন চুপিচুপি। আমরা কেউ ভুল করে গাইবো না ঘুমভাঙা গান। এমন আনন্দের দিনে আমরা চোখের জল ফেলবো না। হৃদয় আর বাংলাদেশের সব জানালা খোলাই থাকবে। মনকাড়া নতুন কোনও সুর নিয়ে, নতুন কোনও গান নিয়ে নিশ্চয়ই ফিরবেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল!

বিশেষ দ্রষ্টব্য: ‘আম্মাজান’ ছবিতে ‘আম্মাজান আম্মাজান আপনি বড় মেহেরবান’ গানটা সুর করেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। গেয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। আর এতে ঠোঁট মেলান মান্না। এই তিনজন মানুষই এখন বেঁচে নেই।

ফেসবুক স্ট্যাটাসে তাকে না ভোলার কথা বলেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। এ দেশের মানুষ তাকে ভুলবে না। তার জন্য আমাদের হৃদয়ের সবক’টা জানালাই খোলা থাকবে।

লেখক: রম্যলেখক