ভাষাই বলে দেয়!

হারুন উর রশীদচট্টগ্রামের চিকিৎসক আকাশের আত্মহত্যা ও তার স্ত্রী মিতুর দায় নিয়ে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরগরম। মূলধারার সংবাদমাধ্যমও পিছিয়ে নেই। এই ঘটনায় আকাশের স্ত্রী মিতু এখন কারাগারে। মামলা হয়েছে মিতুসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে। এখন তদন্তে বেরিয়ে আসুক আর আদালতে প্রমাণ হোক এই আত্মহত্যার দায় কার। কে কতটুকু দায়ী। তবে আমি সেই দায়-দায়িত্ব নির্ধারণের নিক্তি নিয়ে এখানে বসিনি। আমার কথা ভাষা দিয়ে। ভাষার দায় নিয়ে।
বিচারের দাবি নিয়ে ফেসবুকে প্রচুর পোস্ট দেওয়া হয়েছে। কেউ এই ঘটনা নিয়ে কবিতাও লিখে ফেলেছেন। সেইসব পোস্টে মিতুর বিভিন্ন ধরনের ছবি রয়েছে। কমেন্টও পড়ছে শত শত। সমাজের একটি সংকটময় পরিস্থিতি নিয়ে মানুষ কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। এই নানান মতামতের প্রকাশকে সমাজের সুস্থতার লক্ষণ বলে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু অধিকাংশ পোস্টের ভাষা ও তার প্রতিক্রিয়ায় যেসব মন্তব্য এসেছে, সেগুলো যদি কেউ মনোযোগ দিয়ে পড়েন তাহলে যেকোনও সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।

সেইসব ভাষার উদাহরণ হিসেবে চাইলেই কয়েকটি দেওয়া যায়। কিন্তু উদাহরণ দিতে গিয়ে  সেগুলো আরও একবার প্রকাশ করতে চাই না। যদি গবেষণা করতাম তাহলে হয়তো উদাহরণ হিসেবে কিছু নমুনা দেওয়ার প্রয়োজন পড়তো। আমার এই লেখা যারা পড়ছেন তারা হয়তো ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেইসব ভাষা লক্ষ্য করেছেন। এসব ভাষা ব্যবহারকারীর মধ্যে সমাজের শিক্ষিত, পরিচিত এমনকি সাংবাদিকও আছেন। ওইসব ভাষা ব্যবহারের প্রতিবাদ হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদকারীর চেয়ে বিকৃত মানসিকতার ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যাই যেন বেশি। এটাই আমাকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।

ওইসব ভাষার মাঝে বিচার দাবির নামে বিকৃত যৌনতা ও কামুক মনোভাবের প্রকাশই বেশি দেখছি। যৌন বিকৃতির প্রকাশ ভাষার মধ্য দিয়েও ঘটে। ভাষার মধ্য দিয়ে শুধু যৌনবিকৃত মানসিকতারই প্রকাশ ঘটে না, এটা ‘বিকৃত সুখ’ লাভের একটা উপায়ও। যারা যৌন জীবনে অবদমিত, অসুখী অথবা বহুগামী মানসিকতার অথবা ধর্ষকাম; তারা এই উপায়কে ব্যবহার করেন। এটি যেমন এক ধরনের রোগ, তেমননই এটি অপরাধও।

তারাই মিতুর বোনের দেওয়া আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক একটি পোস্টে গিয়ে কোনও যৌক্তিক সমালোচনা না করে উল্টো তাকেই বিকৃত সব শব্দ ব্যবহার করে জবাব দিয়েছে। সেইসব শব্দ অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় তাতে তাদের ধর্ষকাম মানসিকতারই পরিচয় পাওয়া যায়। পোশাক, চাল-চলন, চেহারা বিশ্লেষণ করে মিতু ও তার বোনকে বিভিন্ন ‘উপাধি’ দিচ্ছেন  তারা। তাতে ওইসব মানুষের বিকৃত চরিত্র ও যৌন বিকৃতির লক্ষণ স্পষ্ট।

আমি যেসব ভাষা এ পর্যন্ত দেখেছি সেগুলোতে ব্যবহৃত কিছু শব্দে যে ধরনের মানসিক অবস্থার প্রকাশ পেয়েছে তা এখানে উল্লেখ করছি।

১. তারা ধর্ষকাম মানসিকতার।

২. তারা বিকৃত যৌন মানসিকতার।

৩. তারা যৌন অবদমিত।

৪. তারা বিকৃত যৌনসুখ নিচ্ছেন।

৫. তারা ওরাল বা ভাষাগত যৌনতায় জড়িত।

এখন আসছি ভাষা কেন গুরুত্বপূর্ণ সেই বিষয়ে। সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উপাদান হলো ভাষা। কারও রুচিবোধ, চিন্তা, চরিত্র ও আকাঙ্ক্ষা ভাষার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। কেউ হয়তো পোশাক পরিবর্তন করে তার বাইরের দৃশ্যে পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। কেউ হয়তো ভদ্র পাড়ায় বাড়ি কিনে সামাজিক মর্যাদার উন্নয়ন ঘটাতে পারেন। কিন্তু নিজের ভেতরটা পরিবর্তন করা এত সহজ নয়। চিন্তার উন্নতি ঘটানোও সহজ নয়। পারিবারিক, শিক্ষা, সমাজকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি, নিজের বিশ্বাস ও নৈতিক অবস্থান থেকে এটা আসে। এর অন্যতম প্রকাশ মাধ্যম হলো ভাষা। ভাষার একটা দৈহিক রূপও আছে। যাকে বলে ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’। এই ভাষা হলো লেজের মতো। একে লুকিয়ে রাখা খুব কঠিন। পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রকাশিত হয়ে যায়। যখন তা প্রকাশ্যে আসে তখন ওই ব্যক্তির চিন্তা ও মানসিকতার পরিচয় বেরিয়ে পড়ে।

আপনারা লক্ষ্য করবেন, কেউ কেউ যৌন উত্তেজক শব্দ ব্যবহার পছন্দ করেন। অশ্লীল গল্প করতে ভালো লাগে তাদের। একটা ইস্যু পেলে নারীদের পোশাক, চাল-চলন, হাঁটা চলা, শরীর নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেন। তারা কিন্তু একইসঙ্গে বলেন, সমাজটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নষ্টা-ভ্রষ্টাদের কারণে। মনে হবে যেন এমন সমাজদরদী আর নেই! মূলত এর ভেতরের দিকে আছে এক গভীর গোপন সত্য। সত্যিকার অর্থে তারা এটা বলে একধরনের বিকৃত যৌন সুখ লাভ করেন। তারা মূলত এর মাধ্যমে নিজেদের অবদমিত যৌন জীবনের বিকৃত বহিঃপ্রকাশ ঘটান। তারা মূলত ধর্ষকাম মানসিকতার।

তাদের মনকে আমি বলি ধর্ষক মন। তারা কোনও ধরনের নারীকেন্দ্রিক একটা ইস্যু পেলেই হলো, যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেন! আদতে এটা কোনও প্রতিবাদ বা ন্যায়বিচারের যুদ্ধ নয়। এটা হলো তাদের বিকৃত যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণের একটি পথ। তারা সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন উপায়ে ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকাশ করে ফেলেন।

ভাষাকে মনের আয়নাও বলা হয়। ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমেই একজনের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। ভাষাই বলে দেয় একজন মানুষ কোন চরিত্রের। তাই মানসিক অবস্থার সঙ্গে ভাষাকে না মিলিয়ে ফেলার জন্য বলা হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে এটা সবসময় সম্ভব হয় না। তবে কেউ কেউ হয়তো ভাষার ব্যবহার ঠিক রেখে নিজের ব্যক্তিগত চিন্তাকে আড়াল করতে পারেন। আমরা হয়তো তাদের চিনতে সাময়িকভাবে ভুল করি। কিন্তু এটা দীর্ঘকাল সম্ভব হয় না। একসময় নিজের চিন্তা ও চরিত্র অনুযায়ী তিনি ভাষা প্রয়োগ করবেনই।

আরেকটি বিষয় বলি। মানুষ যখন বিচ্ছিন্ন থাকে তখন হয়তো অনেক সময় তার ভেতরের চেহারা প্রকাশ পায় না। লুকোনো থাকে। কিন্তু আড্ডায়-আলোচনায় তা মানুষের অবচেতন মন থেকে সামনে চলে আসে। ফেসবুক তার একটি প্রমাণ। লক্ষ্য করবেন— একজন যখন কোনও বিকৃত পোস্ট দেয় সেখানে একই চিন্তার মানুষ জড়ো হয়ে একই ধরনের আরও মন্তব্য করতে থাকে। অবশ্য বিপরীত মন্তব্যও থাকে, তবে তা সংখ্যায় কম।

পাদটীকা: ২০১৭ সালের ২১ জুলাই বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন ব্যক্তিত্বের উপাদান তার কথাতেই লুকিয়ে থাকে। টেক্সাস ইউনিভার্সিটির গবেষকরা ৭০০ ব্লগের কয়েক হাজার শব্দ ও সেইসব শব্দ বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, যারা যেমন শব্দ বা ভাষা ব্যবহার করেছেন তার সঙ্গে তাদের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের মিল আছে। টুইটারে ব্যবহার করা ভাষা নিয়ে গবেষণা করেও একই ফল পেয়েছেন তারা।

তাহলে বুঝতেই পারছেন, ভাষাই বলে দিচ্ছে আপনি কে? আমি কে?

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: swapansg@yahoo.com