নির্বাচনের ফলাফল বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে। নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু এই দাবি যে আদায়যোগ্য নয়, কিংবা অন্য কথায়, এই দাবি আদায়ের সক্ষমতা যে বিএনপির নেই, সেটা সম্ভবত তারা বুঝতে পারছে না। তারা আসলে তাদের শক্তি এবং তাদের ওপর মানুষের প্রকৃত আস্থা-ভরসা কতটুকু সেটাও বুঝতে পারছে না। তাই তারা যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা মানুষের সমর্থন পাচ্ছে না।
নির্বাচন খুব ভালো হয়েছে, সবাই ভোট দিতে পেরেছে তা হয়তো নয়। ভোট দিতে না পারার ক্ষেত্রে একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয়েছিলো, অর্থাৎ বিএনপি সমর্থকরা যদি ভোট দিতে না পেরে থাকে তাহলে আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও সেটা পারেনি, কিন্তু ভোটের ফলাফল মেনে নিয়েছে। ভোটের ফলাফল নিয়ে মানুষ কোথাও বিক্ষোভ করেনি, কোথাও অসন্তোষের কোনও বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখা যায়নি। কারণ, মানুষ আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছে, শেখ হাসিনা ছাড়া আর কাউকে মানুষ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাবেনি, বিবেচনা করেনি। মানুষের প্রত্যাশার বিপরীতে কিছু ঘটলে পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত হলেও হতে পারতো। যদি কেউ বলেন যে পাবলিক পারসেপশন হলো ৩০ ডিসেম্বর শতভাগ ভালো নির্বাচন হয়নি, তাহলে তাকে এটাও বুঝতে হবে যে, নির্বাচনের ফলাফলটা পাবলিকের হিসাবের বাইরে হয়নি। ভোট দিতে না পারার দুঃখবোধ কারো থাকলেও বিএনপির পরাজয়ে বেদনা বা হাহাকার নেই। বিএনপির পরাজয়টা ছিল অনিবার্য। সে জন্যই বিএনপির নতুন নির্বাচনের দাবির প্রতি সেভাবে জনসমর্থন পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।
সংসদে বিরোধী দলের অবস্থান এতটাই দুর্বল যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও সম্ভবত বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে। সেজন্যই তিনি যাদের নিয়ে একসঙ্গে নির্বাচন করলেন তাদেরই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পরামর্শ দিয়েছেন। জোট-মহাজোট থেকে আগে মন্ত্রী করা হলেও এবার হয়নি। জাতীয় পার্টি আগেরবার ছিল টু-ইন ওয়ান, সরকারেও, বিরোধী দলেও। এবার তারা শুধুই বিরোধী দল। আবার জাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টিকেও এবার বিরোধী ভূমিকায় দেখতে চান প্রধানমন্ত্রী। এরা প্রকৃত বিরোধী দল হতে পারবে কিনা তা নিয়ে নানা প্রশ্ন-বিতর্ক আছে। প্রধানমন্ত্রীও সেটা বোঝেন। আর সেজন্যই বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টকে তিনি শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সংখ্যায় কম হলেও বিরোধীদের ন্যায্য সমালোচনার মূল্যায়ন করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনার আশা থেকেই হয়তো তিনি গণভবনে রাজনীতিকদের চা-চক্রে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে গণভবনে যাননি বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের এবং বাম জোটের কোনও নেতা। তারা এই সৌজন্য বিনিময়কে অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন। শীতবিকেলে পিঠা-পুলির স্বাদ নিয়ে একটু মুখমিষ্টি করলে রাজনীতির তিক্ততা দূর হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হতো না– এমনটা আগে থেকে ধরে নেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত হলো সে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। শীতের পিঠা খেতে খেতে রাজনৈতিক বিষয়ে কথা চালাচালি করলে সেটা খুব দোষের হতো না। প্রধানমন্ত্রীর ডাকে যারা গণভবনে গিয়েছিলেন তারা এখন বর্তমান সরকার বা আওয়ামী লীগের মিত্র হিসেবেই পরিচিত। যারা সরকারের কঠোর সমালোচক তারা শীতের পিঠা না খেয়ে কী বার্তা দিলেন? তারা সরকারের সঙ্গে সমঝোতা নয়, সংঘাতের পথেই হাঁটবেন?
দেখা যাক এই রাজনৈতিক কৌশল তাদের জন্য কতটুকু সুফল দেয়?
ওদিকে নির্বাচনের পর থেকেই ঐক্যফ্রন্টের শরিক গণফোরামে গৃহবিবাদ শুরু হয়েছে। বিএনপির সঙ্গেও গণফোরামের ড. কামাল হোসেনের সম্পর্ক উষ্ণ না হয়ে শীতল হওয়ার খবরই পাওয়া যাচ্ছে। সংসদে যাওয়া না-যাওয়া নিয়েই মতভিন্নতা দেখা দিয়েছে। সমস্যাটা বিএনপির চেয়ে গণফোরামে বেশি বলে মনে হয়। গণফোরাম থেকে দুইজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এটা গণফোরামের জন্য বড় অর্জন। গণফোরাম এই অর্জন ধরে রাখতে চাইবে– এটাই স্বাভাবিক। বিএনপি পেয়েছে ছয়টি আসন। এটা বিএনপির অর্জন নয়। বরং গ্লানি। এই গ্লানি বিএনপি বহন করতে না-ও চাইতে পারে। এখন বিএনপির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে গণফোরামের কোনও লাভ নেই। তাই সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে ড. কামাল হোসেন ব্যক্তিগতভাবে ইতিবাচক। কিন্তু বিএনপির চাপে তিনি স্যান্ডউইচ। আবার তার নিজ নিজ দলের ‘হারু সাহেব’রাও সংসদবিরোধী। কিন্তু বিজয়ী দুই সংসদ সদস্য– সুলতান মোহাম্মদ মনসুর এবং মোকাব্বির খান শপথ নিতে চান, সংসদে যেতে চান। এরমধ্যে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মানুষ তাকে ভোট দিয়েছেন সংসদে যাওয়ার জন্য। তিনি ভোটারদের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান জানাতে চান। তিনি যেকোনও দিন শপথ নেবেন এবং সংসদে যাবেন বলে জানিয়েছেন।
গণফোরামের ভেতরের মতবিরোধ যেমন প্রকাশ্যে এসেছে, তেমনি বিএনপির সঙ্গে কামাল হোসেনের টানাপড়েনের বিষয়টিও গোপন নয়। কামাল হোসেন জামায়াতের সঙ্গে চলতে চান না। বিএনপি জামায়াত ছাড়তে চায় না। তাহলে এই দুই দল একজোটে থাকতে পারবে? যদি এক থাকেও তাহলেও কি তারা রাজনৈতিক লক্ষ্য ও কৌশলে এক হতে পারবে? হাসিনা বিরোধিতা বা আওয়ামী লীগ বিরোধিতার রাজনীতি কি আর সেভাবে হালে পানি পাবে?
ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলো নেতানির্ভর। তাদের সাংগঠনিক শক্তি ‘হেভি’ না হলেও হেভিওয়েট নেতা আছেন কয়েকজন। তাদের গায়ে মানে না আপনি মোড়ল অবস্থা। এদের একজন কাদের সিদ্দিকী। মুক্তিযুদ্ধে তিনি বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদেও কাদের সিদ্দিকী সাহস দেখিয়েছেন। কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে যে রাজনীতি শুরু করেছেন কিংবা ঠিকাদারি করতে গিয়ে তিনি যে অসততার পরিচয় দিয়েছেন তা তার অতীত গৌরবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কাদের সিদ্দিকী রাজনীতিতে কোনও বড় ফ্যাক্টর না হলেও আলোচনায় থাকার জন্য তিনি মুখরোচক, চটকদার এবং ‘উল্টাপাল্টা’ বিতর্কিত কথাবার্তা বলে থাকেন। যেমন কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর এমপি হিসেবে শপথ নিলে পাবলিক নাকি তাকে টুকরো করে ফেলতে পারে।
পাবলিকের এমন মনোভাব কোথায় পেলেন ‘বঙ্গবীর’। সুলতান মোহাম্মদ মনসুর সংসদে যাবেন, আর কাদের সিদ্দিকী বাইরে ‘ফ্যা ফ্যা’ করবেন, এটা তিনি মানতে পারছেন না বুঝি। তাই সুলতান মোহাম্মদ মনসুরকে ‘টুকরো’ করার হুমকি দিচ্ছেন পাবলিকের ঘাড়ে বন্দুক রেখে। এ ধরনের স্বেচ্ছাচারী, উসকানিমূলক, দায়িত্বহীন কথা যার মুখ দিয়ে বের হয় তাকে আর যাই হোক গণতন্ত্রদরদী বলা যায় কি? ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হলেই কি যা খুশি তা বলা বা করার অধিকারী হওয়া যায়?
লেখক: কলামিস্ট