নিউ জিল্যান্ড বিশ্বের অন্যতম একটি শান্তিপূর্ণ দেশ। কাজেই ওই দেশে এরকম একটি নৃশংস ঘটনা ঘটায় দেশটির সাধারণ মানুষ যারপরনাই বিস্মিত। শান্তি ও সহিষ্ণুতার সুনামে কলঙ্কের দাগ পড়ে গেছে নিউ জিল্যান্ডে! দেশটির প্রধানমন্ত্রী এই হামলার ঘটনাকে দেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, এ ধরনের হামলার ঘটনায় নিউ জিল্যান্ডের মূল্যবোধে ফাটল ধরানো যাবে না। দুই শতাধিক জাতি বিশ্বাস ও ১৬০টি ভাষার মানুষ নিয়ে এই দেশটি গঠিত। হামলায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে নিউ জিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, হামলাকারীদের আদর্শের প্রতি তীব্র নিন্দা জানাই।
নিউ জিল্যান্ডের এই নৃশংস ঘটনায় পৃথিবীব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়েছে। কিন্তু নতুন কোনও ঘটনায় হয়তো অচিরেই এটি চাপা পড়ে যাবে। তবে মাত্র পাঁচ মিনিটের সেই রুদ্ধশ্বাসপূর্ণ ঘটনার কথা কি আমরা ভুলে যাবো? কেউ বলছেন ৩/৪ মিনিট, কেউ বলছেন পাঁচ মিনিট পর নিউ জিল্যান্ডের ওই মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটলে বাংলাদেশে শোকের বন্যা বয়ে যেত। কারণ, ওই মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য রওনা দিয়েছিলেন তামিম, মিরাজসহ অন্য ক্রিকেটাররা। কিন্তু প্রশ্নটা কি থেকেই যায় না বাংলাদেশের জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা একটি মসজিদে নামাজ পড়তে যাবেন, কাজেই তাদের নিরাপত্তার জন্যও তো সতর্কতা জরুরি। অথচ ওই মসজিদে কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থাই ছিল না। একনাগাড়ে প্রায় ১৭ মিনিট ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে নৃশংস হামলা হয়েছে। হাতে বন্দুক, হেলমেটে ক্যামেরা নিয়ে ঠান্ডামাথায় গুলি করে মানুষকে পাখির মতো হত্যা করেছে একজন ঠান্ডামাথার খুনি। অথচ এই সময়ের মধ্যেও পুলিশ আসেনি! শান্তিপূর্ণ দেশটিতে এ কেমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা! বাংলাদেশের মতো কোনও দেশে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে নিরাপত্তার নানা প্রসঙ্গ তুলে এতক্ষণে কত যে কটু কথা বলা হতো! অথচ একটি দেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যরা এক জায়গায় যাবে, সেক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কোনও উপস্থিতিই ছিল না। ক্রাইস্টচার্চের ওই মসজিদে নামাজ পড়তে আসা একজন মুসল্লি প্রচারমাধ্যমে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, ‘প্রায় বেলা ১টা ৪৫ মিনিট বাজছিল। গুলির শব্দ শুনে আমি থেমে যাই। একপর্যায়ে মসজিদে গিয়ে দেখি অনেক মানুষ মসজিদের ভেতর শুয়ে বসে আছেন। দরজার কাছে একটা বন্দুক পড়ে আছে। আমি ভয়ে মসজিদের পেছনে গিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখি এবং পুলিশকে ফোন করি। কিন্তু পুলিশ আসতে দেরি করে’।
ভাবুন তো একবার, বাংলাদেশের মতো কোনও দেশে এ ধরনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামান্যতম গাফিলতি হলে সমালোচনাটা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াতো ? সেখানে ১৭ মিনিট ধরে দুটি মসজিদে গুলি করে পাখির মতো অসহায় মানুষকে মারা হলো অথচ নিরাপত্তা বাহিনীর কোনও তৎপরতা ছিল না।
বাংলাদেশে অন্য দেশের খেলোয়াড়রা এলে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হয়। সেই তুলনায় বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা কি সেরকম নিরাপত্তা পায় অন্য দেশে! জাতীয় দলের একাধিক খেলোয়াড় একটি মসজিদে নামাজ পড়তে যাবে সে ব্যাপারে নিশ্চয়ই নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড আগে থেকেই জানতো? তাহলে কেন নিরাপত্তার দিকটা দেখা হলো না? ধরা যাক পাঁচ মিনিট আগেই বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যদি ওই মসজিদে ঢুকতো তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াতো? ভাবতে গিয়েই ভয়ে গা শিউরে উঠছে! বারবার তামিম, মিরাজ, তাইজুল আর সৌম্য সরকারের ছবির দিকে তাকাচ্ছি। থ্যাংকস গড! আমাদের গর্বের ধন ক্রিকেটাররা সুস্থ আছে। তারা ভালো আছে।
ধারণা করাই যায় নিউ জিল্যান্ডের নৃশংস ঘটনার পর বাংলাদেশের কিংবদন্তি ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজার মনের ভেতরে কী ধরনের তোলপাড় চলছে। প্রচারমাধ্যমে মাশরাফি বলেছেন, আর নির্ভার থাকার সুযোগ নেই। কথা বলেছি তামিমের সঙ্গে। ওর কাছেই জানলাম ঘটনার বিস্তারিত। দুই-তিন মিনিটের ব্যবধানে বেঁচে গেছে সবাই। মাশরাফি বলেছেন, নিউ জিল্যান্ডের মতো দেশে যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে তখন আমাদের প্রতিটি সফরে নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতেই হবে। আমাদের দেশে যখন কোনও দল খেলতে আসে, তাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হয়। যেটা সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধানরা পেয়ে থাকেন। বিশ্বমানের নিরাপত্তা দেওয়ার পরও আমাদের কত কথা শুনতে হয়। সাধারণ কোনও দর্শকের ঢিল পড়েছে টিম বাসে, সেটা নিয়ে বিশ্বগণমাধ্যমে কী যে হইচই শুরু হয়ে যায়। এটাও সত্যি, নিউ জিল্যান্ডের মতো দেশে এমন ঘৃণ্য ঘটনা ঘটবে, এটা ভাবাই যায় না। কাজেই এখন থেকে ভীষণ সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে। কারও আর নির্ভার থাকার সুযোগ নেই।
বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান নিউ জিল্যান্ডে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ঘটনার সময় বাংলাদেশ দলের নিরাপত্তায় পুলিশ দূরে থাক, স্থানীয় কোনও লিয়েজোঁ কর্মকর্তাও ছিলেন না। নাজমুল হাসান বলেছেন, আমরা যখন বিদেশে যাই, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া বলেন, নিউ জিল্যান্ড বলেন, ওই ধরনের দেশে নিরাপত্তার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায় না। কাজেই এখন থেকে আগে নিরাপত্তা, তারপর বিদেশ সফর।
ক্রিকেট হলো অনেকটাই মানসিক শক্তির খেলা। নিউ জিল্যান্ডের ঘটনায় দেশের ক্রিকেটাররা মানসিকভাবে বোধকরি ভেঙে পড়েছেন। সামনে বিশ্বকাপে খেলার আগে ক্রিকেটারদের মন থেকে নিউ জিল্যান্ড বিভীষিকার চিত্র মুছে ফেলাই হবে জরুরি কাজ। আশা করি এ ব্যাপারে আমরা সকলেই ক্রিকেটারদের পাশে থাকবো। নিউ জিল্যান্ডের মসজিদে নিহতদের স্মৃতির প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করি। জয় হোক বাংলাদেশের ক্রিকেটের।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক: আনন্দ আলো।