পৃথিবীতে নানান জাতির মানুষ যেমন রয়েছে এবং থাকবে তেমনি অনেক রকম ধর্ম বা ধর্মবিশ্বাসও রয়েছে কিংবা থাকবে। একইভাবে বর্ণবৈষম্য যেমন বিলুপ্তকরণ সম্ভব, উগ্র ধর্মীয়বাদ তেমনি দূর করা অসম্ভব কিছু নয়। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, উগ্রবাদী মতবাদ দমন করা কঠিন কাজ। কারণ, বর্ণবাদ দূর করা সম্ভব ধর্মের শান্তির বার্তা দিয়ে। কিন্তু উগ্রবাদ চিন্তাচেতনা ধর্মকে ভুল ব্যাখ্যায় দাঁড় করায়। যেমন, নিউ জিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে গুলিবর্ষণের ঘটনার প্রণোদনা হিসেবে হোয়াইট ন্যাশনালিজমকেও একটি বড় কারণ ভাবা হচ্ছে।
আসলে বর্ণবাদ আর উগ্রবাদ দুটোরই মূল উসকানিদাতা হচ্ছে গিয়ে উগ্র-জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ তার ভিত্তি বর্ণবাদই হোক আর উগ্রবাদ হোক, যদি তা উগ্র জাতীয়তাবাদের রূপ ধারণ করে- তাহলেই যত বিপত্তি। আবার এটাও সত্যি যে, জাতিরাষ্ট্র এবং ক্ষমতার রাজনীতির ধারণা যতদিন পৃথিবীতে থাকবে ততদিন জাতীয়তাবাদের ধারণাও পৃথিবীতে থেকে যাবে। আর যতদিন মানুষ থাকবে, এমনকি যতদিন অন্য একটি প্রাণীর অস্তিত্বও পৃথিবীতে থাকবে, ততদিনই পৃথিবীতে ক্ষমতার রাজনীতিও থাকবে। তাহলে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান কোথায়?
বর্তমান সমস্যার সমাধান হচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদকে পরিহার করা। সহজ কথায় যে কোনও ধরনের চরমপন্থাকে পরিহার করা। চরমপন্থা হোক তা ধর্ম, বর্ণ কিংবা কোনও রাজনৈতিক বিশ্বাসনির্ভর– এর শেষ গন্তব্য হচ্ছে উন্মত্ত সন্ত্রাসবাদ। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হচ্ছে নিউ জিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের ঘটনাটি।
আন্তর্জাতিক মিডিয়া যত সুকৌশলেই সন্ত্রাসী শব্দটিকে এড়িয়ে যাক না কেন, নিউ জিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বিষয়টিকে সন্ত্রাসী আক্রমণ হিসেবেই অভিহিত করেছেন। আর সেটাই হওয়া উচিত।
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যারাই ঘটাবে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তাদের সবাইকে এক ও অভিন্ন নামেই ডাকা উচিত ‘সন্ত্রাসী’। আর সংশ্লিষ্ট দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সব সন্ত্রাসীর সমমানের বিচারই হওয়া উচিত।
তাহলে একবিংশ শতকের আসল যুদ্ধটি হওয়া উচিত সব ধরনের উগ্রবাদ কিংবা চরমপন্থার বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধ মোটা দাগে অসহিষ্ণু মানুষের বিরুদ্ধে স্থূল যুদ্ধ নয়। যুদ্ধটি হতে হবে অসহিষ্ণু চরমপন্থী মানসিকতাকে সহিষ্ণু মানসিকতায় রূপান্তরিত করার একটি সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধ। কথিত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিগত কিংবা চলমান যুদ্ধে যে কোটি কোটি অর্থ ব্যয় হয়েছে কিংবা হচ্ছে তা আদতে অর্থহীনই থেকে যাবে যতদিন না উগ্রবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে, সার্বিক চরমপন্থার বিরুদ্ধে, আর পরধর্ম ও পরমত অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সামাজিক যুদ্ধ সৃষ্টি না করা যাচ্ছে।
বিশ্বনেতাদের বোঝার সময় এসেছে, ঘৃণাকে নির্মূল না করে ঘৃণিতকে নির্মূল করার চেষ্টা নিজের ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করার মতোই অর্থহীন। আর ঘৃণাকে কেউ ঘৃণা দিয়ে নির্মূল করতে পারেনি। ঘৃণার মুক্তি কেবল ভালোবাসায়। ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ-চিন্তা-ধর্ম-শ্রেণি কিংবা বিশ্বাসে ঘৃণার নয়, ভালোবাসার সহাবস্থানকে বিশ্বাস করতে হবে সব বর্ণ-চিন্তা-ধর্ম-শ্রেণি কিংবা বিশ্বাসের মানুষকেই। একুশ শতকের স্লোগান হোক– চরমপন্থা নিপাত যাক, ভালোবাসা মুক্তি পাক।
লেখক: আন্তর্জাতিক আইন গবেষক ও আইনজীবী (বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট)
ইমেইল: shawn.mahatab@gmail.com