সুখ গেলো কই!

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীসম্প্রতি প্রকাশিত সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০ ধাপ পিছিয়ে গেছে। তালিকাটি প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশন নেটওয়ার্ক। জাতিসংঘের এই হ্যাপিনেস ইনডেক্স রিপোর্টে বিশ্বের ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫তম, আর তা গত বছর ছিল ১১৫তম। সুখী দেশের স্থান নির্ণয়কালে সেদেশের মানুষের মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, সামাজিক সহযোগিতা, সামাজিক স্বাধীনতা, উদারতা, সমাজে দুর্নীতি কত কম ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ২০১৯ সালের প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। তাতে আমরা ১০ ধাপ পিছিয়ে গেছি।
বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন কিন্তু ২৯ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি ছিল। পরের বছরও তেমন উন্নতি হয়নি। বরং ঘাটতি বেড়ে ৩০ লাখ টনে গিয়ে দাঁড়ায়। রফিক আজাদ কবিতা লিখলেন আর প্রগতিবাদীরা পত্রিকাও হেডলাইন করলেন- ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো’। দুর্ভিক্ষ হলো। কাপড়-চোপড়ের অভাবও ছিল। এক পত্রিকা জাল পরা এক নারীর ছবি ছাপলো। ইজ্জত ঢাকতে কোনও মহিলা কি কখনও জাল পরে? যুদ্ধের পরে সবাই যেন বৈরী হয়ে গেলো। তিলকে তাল করে প্রকাশ করলো। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ চলেছে। রাস্তাঘাট ব্রিজ কালভার্ট সবই বিধ্বস্ত। ভারত থেকে ফিরে আসতে শুরু করেছে এক কোটি লোক। রাজকোষ শূন্য। সত্যই তখন দেশ চালানো ছিল খুবই কঠিন।

যাই হোক, সে সময় আমরা উত্তরণ করে এসেছি। তখন লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, এখন লোকসংখ্যা ১৬/১৭ কোটি। তখন খাদ্য উৎপাদন হতো এক কোটি টন, এখন উৎপাদন হয় তিন কোটি টন। কৃষিজমি এক ইঞ্চিও বাড়েনি, বরং কমেছে। বসতি বাড়লে তো জমি কমবেই। উন্নত প্রযুক্তি আর অধিক ফলনের ধানবীজ উদ্ভাবন করে আমাদের কৃষিবিদরা চরম উৎকর্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। এখন আমাদের খাদ্যের অভাব নেই। দুর্যোগ হলে কালেভদ্রে হয়তো খাদ্য আমদানি করতে হয়। তাও সামান্য।

বাঙালি বহুকাল পরে জঠর জ্বালা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। এ কিন্তু বড় সুখ। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে অর্ধেক বাঙালি মরেছে না খেয়ে। তেতাল্লিশের মন্বন্তরেও কম মানুষ মরেনি। আগে আমরা দেখেছি প্রতিবছর বন্যা হতো। পাকিস্তানের সময়ে প্রত্যেক জনসভায় দেখতাম পূর্ব-বাংলায় বন্যানিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে প্রস্তাব পাস হতো। কার কথা কে শুনে। কোনও প্রধানমন্ত্রীই পূর্ব-বাংলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে দৃষ্টি ফেরাবার কোনও ফুরসতই পাননি।

কিন্তু ১৯৫৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানের রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে অংশীদারিত্বে মন্ত্রিসভা গঠন করে এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন তখন তিনি নেদারল্যান্ডসের ক্রুক সাহেবকে প্রধান করে এক মিশন গঠন করেছিলেন। ক্রুক সাহেব বন্যা নিয়ন্ত্রণের এক পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন। শুনেছি সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে নাকি এক হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন ছিল। তখন সর্বসাকুল্যে পাকিস্তানের বার্ষিক কেন্দ্রীয় বাজেট ছিল ৩৫০ কোটি টাকার। এক হাজার কোটি টাকা পাবে কই? কোনও সরকার আর এ পরিকল্পনা স্পর্শও করেনি।

তখন বন্যা হলেই আমরা ক্রুক মিশন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন চেয়ে মিছিল করতাম। চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে আমার বাড়ির পাশে গুমানমর্দ্দন বিল নামে মস্তবড় এক বিল ছিল। ৩০ বছর বন্যার কারণে কৃষক কাঁচি নিয়ে বিলে যায়নি ধান কাটতে। কৃষক নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো। জোয়ান ছেলেরাও তখন লেংটি পরতো। সে দুঃখ এখন আর নেই। বন্যা এখন আর হয় না। ক্রুক মিশন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি, তবে বন্যা কেন হচ্ছে না। বন্যা গেলো কই? বন্যা না হওয়ার লীলা কী?

বাংলাদেশের ৫৪টা বড় নদীর উৎসস্থল হচ্ছে ভারত। ভারত প্রায় নদীতে এখন হয়তো সেচের জন্য, না হয় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধ দিয়েছে। গঙ্গাতে ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তা নদীতে গজলডোবায় বাঁধ তৈরি করেছে। এখন উজান থেকে ভাটিতে তেমন পানি আর আসে না। বাংলাদেশ ভাটির দেশ তিস্তায় গঙ্গায় একাধিক বাঁধ দিয়েছে ভারত। গঙ্গার পানিতে প্রতি বর্ষায় বিহারে বন্যা হয়।

বিহার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমার গত বর্ষায় দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় অতিষ্ঠ হয়ে কেন্দ্রের কাছে ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। গঙ্গার পানি, তিস্তার পানি খাল কেটে রাজস্থান পর্যন্ত নিয়েছে। ভাটির দিকে পানির প্রেসার কম। এ কারণে বাংলাদেশে এখন আর পূর্বের মতো বন্যা হয় না।

আর এখন বাংলাদেশের খাল-বিল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত পানি সরে যাওয়ার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষায় উজান থেকে বেশি পানি ছাড়লে আর প্রবল বারিপাত হলে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ১৯৯৮ সালে অনুরূপ একটা দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হয়েছিলো বাংলাদেশে। উত্তরবঙ্গ থেকে পানি সরতে দীর্ঘ ৪৩ দিন সময় লেগেছিলো। বাড়িঘর পানিতে পচে গিয়েছিলো। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। শেখ হাসিনার সরকার তখনই বন্যাটা সামাল দিয়েছিলো খুবই সাহসিকতার সঙ্গে। কোনও লোক না খেয়ে কষ্ট পায়নি। বন্যা-উত্তর পুনর্বাসনের কাজও হয়েছিলো খুবই সুচারুরূপে। তখনই তিনি প্রমাণ রেখেছিলেন তিনি দেশ শাসনের যোগ্যতা রাখেন।

২০০১ সালের নির্বাচনে তার দল পরাজিত হওয়ায় তিনি পুনরায় ক্ষমতায় আসতে পারেননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি পুনরায় ক্ষমতায় এসে এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আছেন। টানা ক্ষমতায় থাকলে দেশের কাজ করা সম্ভব হয়। তিনিও তা করার চেষ্টা করছেন। ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিয়ে তার সরকারের যাত্রা শুরু, এখন ২০ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছেছে। নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে গেলে আরও ৫-৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। অবকাঠামোর উন্নয়নের কাজও চলছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। জাতীয় উৎপাদন বেড়েছে। প্রবৃদ্ধি ধনাত্মক। এবার সম্ভবত প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এজন্য বলছি, সমৃদ্ধি বাড়লে সুখ গেলো কোথায়? জাতিসংঘের হিসাবে বাংলাদেশ ১০ ধাপ পিছিয়ে গেলো কেন?

জাতিসংঘের প্রতিবেদন পড়ে বুঝলাম ধন থাকলেই একটা দেশ সুখী দেশ হয় না। পেট ভরে খাওয়াতে কেবল শান্তি নেই। শান্তিপূর্ণ সমাজও চাই। আইনশৃঙ্খলা মেনে চলে এমন মানুষ চাই। অন্যায়কে অন্যায় আর ন্যায়কে ন্যায় বলার মানুষও সমাজে থাকতে হয়। পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা থাকতে হয়। জাতিসংঘের হ্যাপিনেস ইনডেক্সে ১০ ধাপ পিছিয়েছে। এগিয়ে গেলেও পরিবর্তনটা কি চোখে পড়ার মতো? কারণ আমরা তখনও রিপোর্টের শেষ ধাপে অবস্থান করতাম।

আমাদের সমাজে মূল্যবোধ তো তিরোহিত হয়ে যাচ্ছে। সমাজ তো অচিরেই ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান তার ছাত্রীকে ডেকে যৌনকর্মের প্রস্তাব করে, তার গায়ে হাত দেয়। ওই ছাত্রীর অভিভাবকরা যখন থানায় মামলা করে তখন অধ্যক্ষের পোষ্য লোকেরা গায়ে আগুন দিয়ে ছাত্রীটাকে হত্যা করে। আবার স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা অধ্যক্ষের পক্ষ অবলম্বন করে। সমাজের অবস্থান কোথায়? অর্থাৎ শিক্ষক শ্রেণিটাও শেষ হয়ে যাচ্ছে।

আবার রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরাও অধঃপতনের শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে। যারা সমাজটাকে সঠিক পথে পরিচালনার দায়িত্ব নেবে তারাই যখন পথভ্রষ্ট তখন পরিত্রাণের উপায় কী? রোগশোকে যদি ডাক্তারের কাছে যান ডাক্তার সাহেব এক হাজার টাকা ফি নেবেন কিন্তু আপনাকে পাঁচ মিনিটও ভালো করে দেখবেন না। দামি দামি ওষুধের আর অসংখ্য টেস্টের একটি তালিকা আপনার হাতে ধরিয়ে বিদায় দেবেন। টেস্ট বাবদ আপনার খরচ হবে ৪-৫ থেকে ১৫-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আপনার আছে কিনা সে খবর ডাক্তার সাহেবের রাখার দরকার কী?

অফিস আদালতে যান, ঘুষের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে যাবেন। ভোট দিতে যান, যোগ্য প্রার্থী পাবেন না। কার ভোট কে দিচ্ছে সে হিসাব পাবেন না। সত্যি অনেক বয়সে এসে বুঝলাম রাষ্ট্রের আর্থিক সমৃদ্ধি শুধু রাষ্ট্রকে সুখময় করতে পারে না, সঙ্গে সুবিন্যস্ত সমাজও প্রয়োজন।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com