আরেকটি চ্যানেল দীর্ঘদিন বেতন দেয় না। এখন সবাইকে ডেকে বলছে তোমরা পদত্যাগ করো, আমরা তোমাদের পাওনা বেতনের সঙ্গে এক মাস বেশি বেতন দিয়ে দেব। এই চ্যানেলের কর্তৃপক্ষ অন্যান্য চ্যানেল থেকে সাংবাদিকদের লোভনীয় সব প্রস্তাব দিয়ে সাংবাদিকদের ডেকে এনে এখন লাইসেন্সের শর্তই শুধু নয়, শ্রম আইনও ভঙ্গ করছে। কারণ সেই কর্মীর পাওনা টাকা তো তাকে দিতে হবেই, সঙ্গে চার মাসের অর্থও প্রদান করতে হবে। কিন্তু এই চ্যানেলের মালিক সেই আইন মানছেন না। তিনি মানছেন না, সরকারও তাকে কিছু বলছে না।
আরও বেশকিছু চ্যানেল, পত্রিকায় এবং অনলাইনেও ছাঁটাই চলছে, বেতন বন্ধ রয়েছে। গণমাধ্যম পেশাজীবীদের জন্য মালিকদের এই আচরণ এক নতুন বাস্তবতা। সংঘাতময় জটিল রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সহিংসতা, দারিদ্র্যসহ নানা সামাজিক সমস্যার কথা যারা প্রচার বা প্রকাশ করে তারা আজ নিজেরাই গভীর অনিশ্চয়তায়। যারা এমনটা করছেন তারা বলছেন আর্থিকভাবে পর্যুদস্ততার কথা। কিন্তু এই সমাজেই আরো অনেক গণমাধ্যম আছে, এই লেখা যেখানে প্রকাশিত হবে সেই বাংলা ট্রিবিউনে বেতন বন্ধ নেই, বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট বন্ধ নেই। এরকম আরো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। এই সংকটের মাঝেও জিটিভি ও সারাবাংলাসহ অনেক মাধ্যমের মালিক বেতনভাতা নিয়মিত রেখে কর্মীদের প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে।
বলতে দ্বিধা নেই গণমাধ্যমের অর্থনীতি ভালো নেই। কিন্তু তার জন্য দায়ী কি সাংবাদিক, কর্মচারীরা? সাংবাদিকরা কোনও প্রতিষ্ঠানেই বিক্রয়কর্মী হিসেবে যোগ দেন না। তারা তাদের কাজটুকু করেন। যদি বাণিজ্যিক ব্যর্থতা কিছু থাকে তাহলে তা মালিকের নিজস্ব ব্যর্থতা, কিংবা তার বিপণন বিভাগের অক্ষমতা। কিছু সমস্যার কথা আমরা জানি। আর এজন্য এখন পথে নেমেছে টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন এটকো, সম্প্রচার মাধ্যমে কর্মরত কর্মীদের সংগঠন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টা–বিজেসি। বিদেশি (বিশেষ করে ভারতীয়) চ্যানেলে বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার, দর্শকের কাছ থেকে ন্যূনতম কোনও পয়সা না পাওয়া, বিজ্ঞাপনদাতা ও বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে থাকা, পশ্চিমা সমাজ থেকে আসা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন চলে যাওয়ার কারণে সংকট বেড়েছে।
কিন্তু তবুও কিছু কথা থাকে। একটি গণমাধ্যমের মালিক নিশ্চয় ভাববেন, তার কর্মীরাই হচ্ছেন তার ব্যবসার প্রাণ এবং তিনি আজকে যে অবস্থানে এসেছেন, তার পেছনে এই কর্মীদের ভূমিকা আছে। যদি এটুকু ভাবেন তাহলে তিনি কী করে কর্মীর বেতন মাসের পর মাস বন্ধ রাখতে পারেন? নানা অজুহাতে কর্মী ছাঁটাই করেন? প্রায় প্রতিটি টেলিভিশন, পত্রিকা, রেডিও বা অনলাইন গড়ে উঠেছে সংশ্লিষ্ট মালিকের অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সহায়ক হিসেবে। এই মালিকরা তাদের মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমকে তার অন্যান্য ব্যবসা ও নিজস্ব আর্থ-সামাজিক সুরক্ষায় ব্যবহার করছেন। এটাই রীতি হলে এখানে লাভক্ষতির প্রশ্ন কি আদৌ আসতে পারে?
এই প্রশ্ন রেখে আলোচনা করতে চাই, যদি দিন শেষে লাভ-ক্ষতির কথাই ভাবি, তাহলে তার বিজনেস মডেলটি কি ভাবনা থেকে তৈরি হয়েছিল? সেখানে কি কোনও ঘাটতি ছিল? একথা তো সত্য, মালিকের বা তার প্রতিষ্ঠানের দুঃসময়ে এই সংবাদকর্মীরাই তার প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে লড়াই করে। এমনকি বেতন অনিয়মিত হয়ে গেলেও তারা অফিস করে, কাজ করে। আর এ কারণেই সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার হয়।
একটি বা দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের গণমাধ্যমগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বেড়ে উঠেনি। এত এত কর্মী কাজ করে, খুব কম প্রতিষ্ঠানেই প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি বা বীমা সুবিধা আছে। পশ্চিমবঙ্গের সুপরিচিত সংবাদপত্র আনন্দবাজার পত্রিকার সাবেক সম্পাদক অভীক কুমার সরকার একবার দৈনিক সমকালের প্রয়াত সম্পাদক গোলাম সারওয়ারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আনন্দবাজার শুরু থেকেই প্রাতিষ্ঠানিকতা ও পেশাগত উৎকর্ষতার দিকে নজর দিয়েছে এবং দীর্ঘ সময় পেরিয়ে সেই জায়গায় পৌঁছুতে পেরেছে।
ঠিক এই জায়গাটায় আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা আছে। আমাদের গণমাধ্যম সেই জায়গায় যেতে পারেনি। গণমাধ্যমের একটা বড় অংশই পুঁজি আর রাজনীতির সঙ্গে লড়ে লড়ে প্রাতিষ্ঠানিকতা ও পেশাদারিত্বের স্তরে যেতে পারছে না। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর ছুঁই ছুঁই সময়েও প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারার মতো সংগ্রাম করছে। খুব কম সাংবাদিকই গর্বের সঙ্গে একটা নাম উচ্চারণ করে বলতে পারে ‘আমি সেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করি’।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা