না, এটিকে কোনোভাবেই শ্রমিকবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে পাঠ করা যাবে না। কিংবা শ্রমিকের সঙ্গে ধর্ষণ মনস্কতার সম্পর্ক হিসেবেও দেখা যাবে না। বরং আমি এটিকে দেখতে আগ্রহী নারীর সামাজিক অধস্তনতার ভিন্ন পাঠ হিসেবে। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত কিংবা সামাজিক পদে মর্যাদাবান যেকোনও নারীও যেকোনও ধরনের পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার হতে পারেন। তাই শ্রেণি এবং লিঙ্গীয় রাজনীতির মধ্যকার সম্পর্ক এতটা সরলীকরণভাবে দেখা যাবে না। শ্রেণি এবং লিঙ্গীয় রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ক আছে, কিন্তু সেটি লিঙ্গীয় রাজনীতিকে বুঝবার মজবুত বাটখারা নয়।
আর গণপরিবহনে ধর্ষণকেও আলাদাভাবে বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। দেশের ঘর এবং বাইরের পরিসরে নারীর অনিরাপত্তাজনিত জারিকৃত ব্যবস্থাপনার মধ্যেই এই ধর্ষণের মতো অপরাধগুলো ঘটছে। ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি দুপুরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় চলন্ত বাসে পোশাকশ্রমিক ধর্ষণের শিকার হন। ২০১৫ সালে মাইক্রাবাসে একজন গারো নারীকে ধর্ষণ করা হয়। ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি বরিশালে চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হন দুই নারী। এরপর ২০১৭ সালে রূপার ঘটনার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট টাঙ্গাইলে আবারও চলন্ত বাসে এক প্রতিবন্ধী কিশোরীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। একই বছরের ৮ এপ্রিল ঢাকার ধামরাইয়ে চলন্ত বাসে এক নারী পোশাককর্মী ধর্ষণের শিকার হন। এর বাইরেও দেশের কয়েকটি স্থানে চলন্ত বাসে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। আমরা একে একে সব ঘটনাই ভুলে যাই। শুধু রূপার ঘটনায় বাসের চালক ও সহকারীসহ চারজনের মৃত্যুদণ্ড ও একজনের সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।
যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় আগুন লাগিয়ে নুসরাতকে হত্যার পর সারাদেশ যেভাবে জ্বলে উঠেছিল, আপাতভাবে মনে হতে পারে, পুরো বাংলাদেশেই নারীর প্রতি সহিংসতার বিপক্ষে। কিন্তু বাস্তবে ঘটে উল্টো। এই ধরনের ঘটনা মিডিয়ায় আসা মাত্রই আরও নানা জায়গায় একই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে। এর কারণ কী? কারণ আমাদের নারী নিপীড়ন বন্ধ করার রাষ্ট্রীয় প্যাকেজটি ভিন্নরকম। আমাদের আইন আছে কিন্তু সেটির ব্যবহার হয় কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আসামিদের গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু পরে তারা জমিনে মুক্তি পায় এবং মামলা চলতে থাকে ১০-১২ বছর। দুই-একটি ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব তত্ত্বাবধান থাকায় মামলা কিছুটা দ্রুত এগিয়েছে। কিন্তু এটা সব ক্ষেত্রে হয়নি।
এটা প্রমাণিত হয়েছে, দুই একটি ঘটনায় ব্যক্তিগত তৎপরতা কিংবা ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির শিকার নারীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ প্রদান কিংবা পরিবারের কাউকে চাকরি প্রদান কোনোভাবেই রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবিলায় কোনও অবদান রাখতে পারছে না। যে কারণে আমাদের কাছে এখন নুসরাতের ভাইয়ের চাকরির যোগদানের ছবি যত বেশি আলো ফেলে, সেই আলোতে মুছে যায় নুসরাত হত্যার বিচার প্রক্রিয়া। চাকরি প্রাপ্তিতে আমরা যতটা মানবতার বাহবা দিই, দ্রুত সময়ে বিচার নিশ্চিত করার জন্য ততটা নড়াচড়া করি না। এভাবেই আমাদের পুরো মনোজগৎ থেকে হারিয়ে যায় নুসরাতরা, তানিয়ারা।
২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে চলন্ত বাসে ২৩ বছর বয়সী এক মেডিক্যাল শিক্ষার্থী গণধর্ষণের শিকার হন। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সাহসের পরিচয় দেওয়ায় ভারতের গণমাধ্যম ওই ছাত্রীকে ‘নির্ভয়া’ নামে অভিহিত করেছিলেন। ওই ঘটনার পর দিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন সাধারণ মানুষ। বিশ্বব্যাপী আলোচিত এ ঘটনায় অতিদ্রুত সময়েই চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেন দিল্লি হাইকোর্ট।
আমাদের কাছে নুসরাতও ছিলেন ‘নির্ভয়া’। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিচারের জিদ জিইয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তারপরও আমরা ঠেকাতে পারছি না ধর্ষণ। ‘প্রয়োজনে সর্বাচ্চ শাস্তি’-মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই প্রয়োজনটা তবে কবে আসবে আমাদের জীবনে?
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: zobaidanasreen@gmail.com