যারা পদ পায়নি, তারা বেশ কিছু অভিযোগ তুলেছে এই কমিটি নিয়ে। তাদের বক্তব্য, সাধারণ সম্পাদকের জেলার লোকের প্রাধান্য আছে এই কমিটিতে। আগে কখনও দল করেনি এমন লোকও কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেয়েছে বলে অভিযোগ আছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কোনও বিবাহিত ব্যক্তি ছাত্রলীগের নেতা হওয়ার কথা নয়, কিন্তু হয়েছেন- এমন অভিযোগও উঠেছে। তাদের কাছে প্রমাণ আছে দাবি করে প্রতিবাদকারীরা আরও বলেছেন– মাদক ব্যবসায়ী, মাদকসেবীও আছে কমিটিতে।
এসব অভিযোগ কোনও বিরোধী দল করছে না। খোদ দলের ভেতর থেকেই এসেছে অভিযোগগুলো। এগুলো কতটা সত্য, কতটা মিথ্যা সেটি নিশ্চয়ই সংগঠন ও দল খতিয়ে দেখবে, ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু একটা ছাত্র সংগঠন তার কমিটি পূর্ণ করতে এক বছর সময় নেয়, কিন্তু তারপরও তা পূর্ণ হয় না। সংগঠনের ভেতর থেকে প্রতিবাদ হয় এবং প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা বলে দেয়, দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা আর শৃঙ্খলা কোন পর্যায়ে আছে।
‘পদ পেতেই হবে’– এই মনোভাব রাজনীতি নয়, ক্ষমতার মোহ। আমরা এর আগে বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটি গঠন নিয়ে প্রতিবাদ ও মারামারি দেখেছি। একজন বাম ছাত্রনেতা জানালেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কমিটি নিয়ে ছোটখাটো উত্তেজনা আছে।
সামগ্রিকভাবে ছাত্র রাজনীতি নিয়েই প্রশ্ন ওঠে এসব দেখে। প্রশ্ন ওঠে ছাত্র রাজনীতি আসলে কোন রাজনীতি। দেশের বর্তমান সাংবিধানিক আইন অনুসারে ১৮ বছর বয়স হলেই যেকোনও নাগরিক নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করেন। ভোট দেওয়ার অধিকারের পেছনে যে গণতান্ত্রিক যুক্তিটি রয়েছে, তা হলো, নির্বাচনি গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিকের মতামতের মূল্য সমান। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ১৮ বা তার চেয়ে বেশি বয়সের শিক্ষার্থীরা রাজনীতি করবে এটা স্বাভাবিক। আর সে কারণেই ছাত্ররা রাজনীতি করবে। কিন্তু তারা কোন রাজনীতি করবে প্রশ্ন হলো সেটি। দলের লেজুড়বৃত্তি করে চাঁদাবাজি বা সন্ত্রাসী হবে, সহিংস আচরণ করবে, নাকি ভবিষ্যতের একজন সুরাজনীতিক হবে?
ক্যাম্পাসে ভালো রাজনীতি হয় না সে কথা কেউ বলবে না। কিছু কিছু ভালো কাজ নিশ্চয়ই হয়। কিন্তু ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে থেকে, সব সুবিধা আর ক্ষমতা উপভোগ করে যে সংগঠন রাজনীতি করে তার রাজনীতি কতটা রাজনীতি? যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তার দলের ছাত্র সংগঠনের দাপটে ক্যাম্পাস গণতন্ত্র বলে একটা ধারণা আছে তা হাওয়া হয়ে গেছে।
ছাত্ররা গণতান্ত্রিক উপায়ে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের প্রশাখায় পরিণত হয়ে নিজস্বতা হারিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রীড়নক হয়ে উঠেছে। তাই এ দেশে ছাত্র রাজনীতি এক বিকৃত রূপ ধারণ করেছে। ক্যাম্পাসগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর রঙ্গমঞ্চে পরিণত হয়েছে, ছাত্র সংগঠনের নেতা, বিশেষ করে বড় দু’টি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা তারাই হয়েছেন, যারা ছাত্র-ছাত্রীদের চাহিদা জানেন না বা জানতে চান না, যারা শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন।
ছাত্রলীগের কমিটি হবে, ছাত্রদলের কমিটি হবে তাদের কর্মীদের প্রত্যক্ষ ভোটে। সেই আয়োজন এই দুই সংগঠনেই নেই। কমিটি আসে মুরুব্বিদের থেকে, যাদের আবার সংগঠনের কর্মীরা নাম দিয়েছেন সিন্ডিকেট। প্রত্যক্ষ ভোটে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের বিধান না থাকায় যারা নেতা হন, সিন্ডিকেটের প্রভাবে বা যোগসাজশে তাদের সঙ্গে বহিরাগতদের যোগাযোগ বেশি, এরা ক্যাম্পাসভিত্তিক একডেমিক পরিসরের কাজ করার চেয়ে অর্থ উপার্জনে পারদর্শী বেশি। এরা পদ বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য করেন। এর নাম রাজনীতি নয়, রাজনীতির নামে পরিহাস।
পশ্চিমা দেশের ছাত্রছাত্রীরাও সক্রিয় রাজনীতি করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর সমাবেশ বা সংগঠন করার অধিকার সেসব দেশে সবার আছে। শিক্ষা ও সামাজিক ইস্যুতে সেসব দেশে ছাত্র আন্দোলন হয়, সভা, সমাবেশ ও মিছিল হয়। কিন্তু আমাদের ছাত্র রাজনীতি সে পথে নেই। এখানে ছাত্র রাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে ব্যাপক দলীয় অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ছাত্র সংগঠনসমূহের এখন আর কোনও স্বাতন্ত্র্য নেই। বাইরের নেতাদের নির্দেশে বা শিক্ষাঙ্গন পরিচালনা করতে চায় এই ছাত্র রাজনীতি। আর এ কারণেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে নানা দুর্নীতি এবং অর্থকরী কার্যক্রম। যেমন, ভর্তি বা সিট বাণিজ্য, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, যার স্বাভাবিক পরিণাম দলাদলি, বিশৃঙ্খলা আর সহিংসতা।
আমার দৃষ্টিতে এ অবস্থা আসলে ছাত্র রাজনীতির পরাজয়। ছাত্র সংগঠনগুলো এমনই পরাজিত যে, তারা যে যে দলের সমর্থনপুষ্ট সেই বড় রাজনৈতিক দলের বা নেতাদের সমালোচনা করার সাহসও রাখে না। যে ষাটের দশককে ছাত্র রাজনীতির উজ্জ্বল সময় বলা হয়, তখন এই ছাত্রলীগসহ সব সংগঠনই মূল দলের বাইরে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। আর সে কারণেই জনগণের সমর্থনও ছিল তাদের দিকে। সে সময়ের ছাত্র আন্দোলনকে বলা হতো ‘ছাত্র-জনতার’ আন্দোলন। আজ ছাত্র আন্দোলন নেই, জনতার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই এই রাজনীতির, এমনকি ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন করা ছাড়া ক্ষমতা কেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতির সম্পর্ক সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেও নেই।
শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগের কমিটিতে কোনও পরিবর্তন আসবে কিনা সেটি সাংগঠনিক বিষয়। কিন্তু দলীয় প্রভাবমুক্ত, সত্যিকারের শিক্ষানুরাগী ছাত্রনেতা, ক্যাম্পাস গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছাত্র রাজনীতি আমরা পাবো কিনা জানি না। প্রায় ২৯ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও হল সংসদ নির্বাচন হলো। কিন্তু সেটিও এই ক্যাম্পাসে রাজনীতির বড় পরিবর্তন আনতে পারেনি এখনও।
ছাত্রদের রয়েছে তীব্র আবেগ, তীব্র ন্যায়-অন্যায়বোধ এবং আদর্শনিষ্ঠ চারিত্র্যিক সততা। এবং এ কারণেই আমরা দেখেছি দেশের স্বাধীনতার আগে এবং পরে সকল গণআন্দোলনে, দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে এই অপরিণামদর্শী তারুণ্য সব সময় সংগ্রামের সামনের সারিতে থেকেছে। সেই ছাত্রছাত্রীরা একটি ভালো রাজনৈতিক সংস্কৃতি যদি না পায় তাহলে আমাদের আগামী রাজনীতি কেমন হবে?
লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা