রূপনগর

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাউৎপাদিত ধানের দাম না পেয়ে সারাদেশে কৃষকের হাহাকার, ক্ষোভ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পদের লড়াই, পদ পাওয়া আর পদবঞ্চিতদের মারামারি, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্রিনসিটি প্রকল্পের ১১০ ফ্ল্যাটের কর্মকর্তাদের জন্য অস্বাভাবিক মূল্যে বালিশ, চুলাসহ আসবাবপত্র কেনা ও ভবনে উঠানোর ঘটনা এখন খবর। কিন্তু আসলে এগুলো কোনও খবর নয়। যে ঘটনা বা বিষয় স্বাভাবিকে পরিণত হয় তা কি আর খবর থাকে? বাংলাদেশে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের মূল্য পায় না, ছাত্রলীগের মারামারি আর কোন্দল, প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি এগুলো এত বেশি ঘটছে যে, মানুষকে খুব একটা অবাক করে না। যা কিছু নিয়মিত তা তো আর খবর নয়। কিন্তু সাংবাদিকরা বলেন, লিখেন। তাদের বলতে হয়, লিখতে হয় পেশার খাতিরে। কিন্তু এই বলা আর লেখা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কোনও রেখাপাত করে কিনা বলা মুশকিল।
দুর্নীতিবাজদের প্রতি সদয় থাকা, সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেওয়া আর বঞ্চিত, হতদরিদ্র মানুষকে অবজ্ঞা করা, তাদের উদ্দেশে অসংবেদনশীল শব্দ উচ্চারণ করাই নিয়ম বা প্রথা। কৃষকের আহাজারি শুনে কেউ যদি বলে এরা এত উৎপাদন করে কেন, তাহলে কি এতে অবাক হওয়া উচিত আমাদের? কারণ আমাদের উন্নতি হচ্ছে আর উন্নয়নের ভাই-বেরাদার হিসেবে দুর্নীতিকেও আমাদের মেনে নিতে হবে, কারো লাভ যখন হবে তখন কারো বঞ্চনাও সইতে হবে। একটা তত্ত্ব তো আছেই, উন্নয়ন হলে দুর্নীতি হবেই। কিংবা আমাদের হয়তো মেনে নিতেই হবে, উন্নয়ন ভালো হবে, দুর্নীতি আরো বেশি ভালো হবে।

গত এক দশকে আমাদের আর্থিক উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার এখন অনেক। কিন্তু দুর্নীতি মাপার প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে বিশ্বের চরম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থানও বেশ পোক্ত।

আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে আমাদের চারদিকের যে সমাজ, তার মাথাব্যথা দিন দিন নিম্নমুখী। ব্যাংকে বেশকিছু বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে কয়েক বছরে, কিন্তু এই খাতে সুশাসন আনার প্রচেষ্টা চোখে পড়ছে না। বরং দেখা যাচ্ছে উল্টোটা। জনগণের অর্থ নিয়ে গড়ে ওঠা ব্যাংক খাতকে দখল করেছে মালিক নামের একটা শ্রেণি। ভালো উদ্যোক্তা ঋণ পায় না, খারাপ উদ্যোক্তা, লুটেরা ঋণখেলাপিদের জন্য নীতিমালা তৈরি করে অবারিত হচ্ছে ব্যাংকের দরজা। 

সে কারণেই প্রশ্ন ওঠে– উন্নয়ন আর দুর্নীতি কি বছরের পর বছর ধরে এভাবে হাতে হাত ধরে এগোবে? জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের আমলে দুর্নীতি কেন বাড়বে? আমরা জানি না দুর্নীতির প্রতি এমন নীতিগত সমর্থন শেষ অবধি সমাজের নৈতিক অবস্থান কোথায় নিয়ে যাবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি কি মানুষের মূল্যবোধকেই বিলীন করে দেবে?

এই ভাবনাগুলো বেশ জটিল। যদি এমন হয়, তাহলে ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়, অফিসে অফিসে সম্মানিত দুর্নীতিবাজের সংখ্যা বাড়বে। আর তখন দুর্নীতি থেকে মুক্ত বা দূরে থাকা মানুষ কেবলই অসম্মানিত হতে থাকবে। অবশ্য অনেকে আমার সঙ্গে দ্বিমত করে বলছেন সেই আলামত নাকি বহু আগে থেকেই চলছে, এখন কেবল পল্লবিত হচ্ছে। এমন একটা সমাজ নির্মাণ করছি আমরা যেখানে যেনতেন প্রকারে অতিমাত্রায় রোজগার না করতে পারলে নিজের সমাজে মর্যাদা পাওয়া যায় না, পরিবারের মানুষজনও ভালোবাসা দেয় না। দুর্নীতি সম্পর্কে সমাজের নৈতিক অবস্থানকে ভঙ্গুর করে দেওয়ার এমন আয়োজন উৎসবের আমেজে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশে।

শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রে যারা থাকেন বা যারা দুর্নীতি থেকে লাভবান হন, তারা বলেন রাস্তা হলে, স্কুল হলে, অবকাঠামো হলে, ব্রিজ হলে, হাসপাতাল হলে, শিক্ষা স্বাস্থ্যের উন্নতি হলে মানুষ দুর্নীতি নিয়ে ভাবে না। তবে কি আমাদের ভেতর একটা চিন্তা জন্ম নিয়েছে, দুর্নীতির একটা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়ে গেছে? এই ভাবনা সুখকর নয়। আমরা ভাবতে চাই, উন্নয়ন এবং নীতির দৌড়ে উন্নয়নের দিকেই পাল্লা ভারী থাকুক।

উন্নয়নের সঙ্গে বৈষম্যের একটা যোগ থাকে। বলা হয় উন্নয়নের জন্য কিছুটা বৈষম্য নাকি মেনে নিতেই হবে। সেটা নিয়েও আলোচনা হতে পারে। তবে উন্নয়ন মানেই দুর্নীতি নিশ্চয়ই বিধান বা নিয়ম হতে পারে না। উন্নয়ন এবং দুর্নীতি হাতে হাত ধরে এগোতে থাকলে একটা সময় উন্নয়নকে পেছনে ফেলে শুধু দুর্নীতিই হতে থাকবে।

সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক উজাড় হয়ে যাওয়া, বড় বড় ঋণখেলাপি তৈরি হওয়ার পর এখন রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের রূপকথাসম দুর্নীতির কথা উঠে এসেছে। পূর্তমন্ত্রী তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। কী হয় দেখার অপেক্ষায় আমরা। অনেকে মনে করেন, অর্থনীতির মডেল না বদলালে দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না। সে আলোচনায় যাচ্ছি না। আমরা জানি রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রশাসনের সহযোগিতায় দেশ চালায়। অনেক কিছুই বুঝি না আমরা, কিন্তু এটুকু বুঝি, দুর্নীতিবাজরা রাজনীতি ও প্রশাসনের ওপর বিপুল আধিপত্য বিস্তার করতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে দুর্নীতির জানালা দরজা খুলতেই থাকবে।  

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা