সংকটের গভীরে টেলিভিশন: উত্তরণের উপায় কী

সাইফুল হাসানবর্তমানে ৩৩টি টেলিভিশন সম্প্রচারে। কয়েকটি সম্প্রচারের অপেক্ষায়। জানা গেছে, আরও অনেক আবেদন পড়ে আছে। দেশে এত টেলিভিশন কি আদৌ জরুরি? কতটি টেলিভিশন ব্যবসা করছে? এত চ্যানেলের পরও দর্শক কেন বিদেশি চ্যানেল, নেটফ্লিক্স বা ইউটিউবে ছুটছে? কতটিতে নিয়মিত বেতন-বোনাস হয়? কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু মানসম্মত? কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে? সম্পাদকীয় ও সম্পাদনা নীতিমালা আছে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা হচ্ছে, ভবিষ্যৎ কি দেশের টেলিভিশন বা সম্প্রচার খাতের?
এসব প্রশ্নের সরল কোনও জবাব নেই। টেলিভিশন খাতের অবস্থা ‘চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া’র মতো। এই লেখা প্রস্তুতির সময়েই দেশ টিভি ৩২ জনকে চাকরিচ্যুত করেছে। কিছুদিন আগেই চ্যানেল নাইন তাদের বার্তা বিভাগ বন্ধ করে দিয়েছে। এর বাইরেও, বিভিন্ন চ্যানেলে গোপনে ছাঁটাই চলছে। পাশাপাশি, বেতনভাতা, চোখ রাঙানি, চাপ, অনিয়মসহ অন্যান্য সংকটও তো আছেই। দিন দিন যা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। 
দেশে, এ মুহূর্তে টেলিভিশনই সম্ভবত সবচেয়ে অসুখী এবং অনিরাপদ খাত। ভয়-শঙ্কা, নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা প্রতিনিয়ত তাড়া করছে সম্প্রচারকর্মীদের। চ্যানেলগুলোর অন্তর্গত বাস্তবতা কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভীষণ বেদনাদায়ক ও নির্মম, যা ঝকঝকে বা ঝিরঝিরে পর্দায় প্রতিফলিত হয় না। এ বাস্তবতায় অনেকে টেলিভিশন ছেড়েছেন। অনেকেই পেশা পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন।

সম্প্রচারকর্মীদের সহনশীলতা ঈর্ষণীয়। নিয়মিত বেতন হয় না, সদা চাকরি হারানোর ঝুঁকি। কিন্তু মুখে সদা হাসি। কাজের পরিবেশ ও পেশাদারিত্ব নেই। এর মধ্যেও প্রতিনিয়ত তথ্য-বিনোদন জুগিয়ে যাচ্ছেন তারা। কিন্তু জোগানদারেরা ভেতরে ভেতরে শুকিয়ে যাচ্ছেন। তাদের খবর কে রাখছে? বিষয়গুলো শুধুই বেতনভাতা বা চাকরির নিরাপত্তার নয়। বরং এর সঙ্গে পেশাদারিত্ব, স্বস্তি, শান্তির প্রশ্নটিও বড়ভাবে জড়িত। টেলিভিশন নিজে গণতন্ত্র, মানবিকতা, স্বাধীনতার বিষয়ে সোচ্চার। অথচ এর কর্মীরা ভীষণ রকমের পরাধীন।

সত্যি বলতে, স্থানীয় টেলিভিশন কাঠামোই মানবিক ও মুক্ত নয়। এর গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াতেই গলদ আছে। যে কারণে টেলিভিশন তার কর্মীর অধিকার স্বীকার করতে চায় না। আর কর্মী নিজের বৈধ অধিকার নিয়ে কথা বলতে ভয় পায়। সব মিলিয়ে চ্যানেলগুলোতে এখন শুধুই অনিশ্চয়তা আর হতাশার গল্প। পেশাদারিত্ব জাদুঘরে। দক্ষ ও যোগ্যরা কোণঠাসা। মুরব্বিদের অনেকেই ‘করপোরেট দালাল’। দলাদলি-তেলবাজি শিল্পমানে। নতুন বিনিয়োগ, বাড়তি বেতনভাতা, সুযোগ-সুবিধার আলাপ নিষিদ্ধ। চমৎকারিত্ব এবং সৌন্দর্য প্রায় অনুপস্থিত। অথচ প্রতিষ্ঠানের প্রত্যাশা তার কর্মী হবে জীবন্ত; ঝকঝকে পর্দার মতো। প্রত্যাশার এই বৈপরীত্যই সম্প্রচার খাতের বাস্তবতা। ফলে অন্যায়, ন্যায্যতা পায় প্রতিবাদহীন।

গত দুই দশকে সম্প্রচারে আসা বেসরকারি চ্যানেলগুলো, কতটা গণমাধ্যম আর কতটা প্রচারমাধ্যম, তা গবেষণার দাবি রাখে। তবে, বাস্তবতা হচ্ছে সম্প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা, আইন, প্রশাসন ও রাজনৈতিক ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। এবং নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে, লাইসেন্সের বিবেচনা রাজনৈতিক হওয়ায় প্রকৃত উদ্যোক্তারা সম্প্রচার ব্যবসায় প্রবেশাধিকার পায়নি। যারা টেলিভিশন মালিক, তাদের কাছে গণমাধ্যম, গণতন্ত্র, মানুষ, জাতীয় স্বাধীনতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দলীয় আনুগত্য। টেলিভিশন তাদের কাছে ব্যবসা নয়, বরং হাতিয়ার।

অথচ টেলিভিশন বা গণমাধ্যম পুরোপুরি ব্যবসা। যেখানে লাভ-লোকসানই আসল। অথচ এত এত চ্যানেল বাজারে এলো, কিন্তু অধিকাংশেরই কোনও ‘বিজনেস মডেল’ নেই। গবেষণা নেই। সম্পাদকীয়-সম্পাদনা নীতি নেই। নিয়োগ নীতি নেই। কর্মীদের মানোন্নয়নের চেষ্টা নেই। প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্বেও, অপেশাদারদের ভিড় ও আস্ফালন। অর্থাৎ খাতটি কাঠামোবদ্ধ হয়ে গড়ে ওঠেনি। এসব কারণেই টেলিভিশন খাত শিল্প হতে পারেনি। ফলে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খারাপ উপসর্গগুলো দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।

ধারণা করা হয়, দেশের বিজ্ঞাপন বাজার ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো। যার সিংহভাগই ব্যয় হয় পত্রিকা, বিলবোর্ডসহ অন্যান্য খাতে। টেলিভিশন, রেডিওর জন্য বরাদ্দ ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ হাজার কোটি টাকা। এরও একটা অংশ খেয়ে ফেলছে ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। প্রতিবছর অনলাইনে বিজ্ঞাপনের বাজার বড় হচ্ছে। ফলে, টেলিভিশনের আয় সংকুচিত হচ্ছে। এই বাস্তবতায় ছোট একটি বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞাপনের মূল্য কমা এবং সিন্ডিকেট হওয়াই স্বাভাবিক। বিজ্ঞাপন নির্ভরতা কাটানো না গেলে আগামীতে আরো অনেক চাকরিচ্যুতি ঘটবে। কিছু কিছু চ্যানেলও বন্ধ হতে বাধ্য। সেটা আজ বা কাল।

দর্শক, স্থানীয় চ্যানেল কেন দেখবে?— প্রশ্নটি টেলিভিশন সংশ্লিষ্ট সবার আত্মজিজ্ঞাসা হওয়া উচিত। স্থানীয় চ্যানেলগুলোর খবর, অনুষ্ঠান, এর ধরন, কাঠামো, টাইমিং প্রায় এক। লোগো ছাড়া চ্যানেল আলাদা করা কঠিন। পাশাপাশি দর্শকের টেলিভিশন নির্ভরতা কমছে। কারণ তার সামনে অনেক বিকল্প। ফলে মানুষ টেলিভিশন না দেখলে, কেউ বিজ্ঞাপন দেবে না। বিজ্ঞাপন না এলে আয় হবে না। আয় না হলে বেতন-বোনাস হবে না। বেতন-বোনাস না হলে কর্মী ও প্রতিষ্ঠান ভালো থাকবে না। পরিণতি, গণ ও গোপন ছাঁটাই, দলাদলি, সুযোগ-সুবিধা কমানোসহ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

সম্প্রচার মাধ্যমের বড় একটা অংশ বিশ্বাসই করে, স্থানীয় চ্যানেলগুলোর সংকট জটিল এবং প্রায় অনিরাময়যোগ্য। পুরো খাত ভেন্টিলেশনে আছে। শুধু আনুষ্ঠানিক ‘মৃত’ ঘোষণা বাকি। এই অবস্থা মূলত টেলিভিশন মালিক-শ্রমিকের সৃষ্টি। কিছু দায় সরকারেরও আছে। অসহনীয় এই পরিস্থিতিতে, এক শ্রেণি নীতি/নৈতিকতা, পেশা বন্ধক রেখে ভবিষ্যৎ মজবুত করছে। জাতিকে সকাল বিকাল নসিহত করছে। কিন্তু নিজেরা অসৎ, সুবিধাবাদী এবং অপেশাদার। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, সংখ্যায় তারা নেহাতই কম নয়। তারা উপরে খাচ্ছেন, তলাতেও কুড়োচ্ছেন। এবং তাদের কারণেই ভুগতে হচ্ছে বেশি।

ফলে, টেলিভিশন কখনও মালিকের হাতিয়ার। প্রভাবশালীর তাঁবেদার। কখনও ঋণখেলাপির ও দুর্বৃত্তদের ডিটারজেন্ট। কখনও করপোরেটদের ব্ল্যাংক চেক। পর্দায় সাধারণ মানুষ নেই, কিন্তু গোষ্ঠীগত উপস্থিতি প্রবল। তাই, টেলিভিশনে জনআস্থা নেই। সম্প্রচার কর্মীদেরও ভরসা নেই। কারণ, প্রতিষ্ঠান তাকে প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখে; স্বস্তি ও শান্তি দেয় না। জনআস্থাও নেই, কারণ টেলিভিশন সত্য হিসেবে এমন কিছু প্রচার করে বা করতে চায়, যা জনসত্য হিসেবে স্বীকৃত নয়। অথবা সে জনসত্য বলতে সংকোচ করে।

অদূর ভবিষ্যতে, এমনিতেই টেলিভিশন ধরাশায়ী হবে নিউমিডিয়া, সামাজিক মাধ্যম বা নতুন প্রযুক্তির কাছে। বর্তমান বাজারে গড়পড়তার দিন শেষ। শুধু বিজ্ঞাপন নির্ভরতায় টিকে থাকা কঠিন। এই বাস্তবতা টেলিভিশন মালিক-কর্মী উভয়ের জন্যই সমান। ফলে টিকতে হলে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা, ইতিবাচকতা ও পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নতুন অনুষ্ঠান, বিনিয়োগ ও বহুমুখী আয়ের পথ খুঁজতে হবে। যদিও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা অন্য যে কোনও ছুতোয় লাইসেন্স বাতিলের খড়গ ঘাড়ে নিয়ে লড়াই করা কঠিন।

এ সত্ত্বেও বলতে হয়, যে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের চোখ রাঙানি ভয় পায়, সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করতে ভয় পায়, জনসত্য তুলে ধরতে ভয় পায়, তা কেবলই প্রচারমাধ্যম। কোনোভাবেই গণমাধ্যম নয়। সুতরাং, আপনার চ্যানেল এইচডি না এসডি, এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনি কী প্রচার করছেন বা করতে চাইছেন। আপনার দাবি, বিজ্ঞাপনের অভাব। অন্যদিকে, বিজ্ঞাপনের ভিড়ে আসল অনুষ্ঠান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর— এমন টেলিভিশন মানুষ দেখবে না। এই বিবেচনাও সবারই থাকা উচিত।

টেলিভিশনের সমস্যা,দর্শকের নয়। দর্শক টেলিভিশন দেখে, সমস্যা নয়। ফলে দর্শক ধরে রাখার মতো অনুষ্ঠান, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ বা তথ্য দিতেই হবে। এক্ষেত্রে কনটেন্টে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। টেলিভিশনের সংকট মূলত নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা, বাজার, বিনিয়োগ এবং বিষয়বস্তু নির্বাচনে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই আলোচনাগুলো আড়ালে-আবডালে চললেও, মূলধারায় ব্রাত্য।

এতসব অসুবিধার মধ্যেও টেলিভিশনে অনেক ভালো কাজ হয়েছে। এখনও হচ্ছে কিছু কিছু। গণতন্ত্রায়ন, মানবাধিকার, অন্যায়, নিপীড়ন, দুর্নীতি প্রকাশসহ অনেক ক্ষেত্রে টেলিভিশনের বড় রকমের সাফল্য আছে। কোনও সন্দেহ নেই, ঠিকঠাক সুযোগ পেলে টেলিভিশনই হতো সবচেয়ে সফল গণমাধ্যম। তারপরও এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি। বরং সবাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালালে খাতটি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।

টেলিভিশন খাত সুরক্ষায় নিচের প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করে দেখতে পারেন সরকার ও খাত সংশ্লিষ্টরা।

১. প্রতিটি টেলিভিশন লাইসেন্সের বিপরীতে, তথ্য মন্ত্রণালয়ে ১০ কোটি টাকা জমার বিধান করতে হবে। কেউ বেতনভাতা, অনুষ্ঠান নির্মাণের পাওনাদি মেটাতে ব্যর্থ হলে জমাকৃত ওই টাকা থেকে সমন্বয় করবে সরকার।

২. দ্রুত সম্প্রচার আইন পাস এবং কার্যকর করতে হবে।

৩. অতিসত্ত্বর সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য আলাদা ওয়েজবোর্ড গঠন এবং সময়োপযোগী বেতনভাতা নির্ধারণ করতে হবে।

৪. অতিসত্ত্বর টেলিভিশন সিগন্যাল ডিজিটাইজেশনের উদ্যোগ নিতে হবে।

৫. ভারতীয়সহ সব বিদেশি টেলিভিশনের ল্যান্ডিং ফি বাড়িয়ে ন্যূনতম ৫ কোটি টাকা করতে হবে।

৬. রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স প্রদান বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে বিদ্যমান টেলিভিশনগুলোকে একীভূত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

৭. সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য একটি কার্যকরী সাংবাদিক-কর্মচারী ইউনিয়ন করতে হবে। কোনোভাবেই একটির বেশি ইউনিয়ন হতে পারবে না।

৮. বিজ্ঞাপনী এজেন্সির সিন্ডিকেট ভাঙতে চ্যানেলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অ্যাটকো এই উদ্যোগটা নিতে পারে। যতবার বিজ্ঞাপন চলবে ততবার অর্থ প্রদানের নিয়ম করতে হবে। একবারের টাকায় তিনবার বিনে পয়সায় বিজ্ঞাপন চালানো বন্ধ করতে হবে।

পরিশেষে, টেলিভিশনে যারা কাজ করেন, এটা তাদের অস্তিত্ব ও পেশার লড়াই। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার লড়াই। মাথা উঁচু করে বাঁচার লড়াই। মালিক ও সরকার পাশে নাও থাকতে পারে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। কেউ আপনাদের এমনিতে কিছু দেবে না। দাবি আদায় করে নিতে হবে। মুক্ত গণমাধ্যম হিসেবে সঠিক ভূমিকা রাখতে পারলে জনগণ পাশে থাকবে। সুরক্ষা দেবে। যার সুফল পেশা-জীবন-জীবিকায় মিলবে।

এতে ঝুঁকি আছে সন্দেহ নেই, তবে সাফল্য আসবেই।

লেখক: সাংবাদিক

saiful.hasan@gmail.com