সবাই দাবি করি, আমরা উন্নত দেশের পথে হাঁটছি। কিন্তু পৃথিবীর এমন একটি উন্নত দেশও আপনি পাবেন না, যেখানে নাগরিকদের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য, সঠিক চিকিৎসা আর শিক্ষার বিষয়ে রাষ্ট্র আপস করেছে। এই তিনটি বিষয়ে কোনও রাজনৈতিক চাপও থাকে না ওইসব দেশে। বরং তারা কঠোরভাবে নাগরিকদের তা নিশ্চিত করেন। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটছে তার ঠিক উল্টোটা।
এও দাবি করা হয় বাংলাদেশ মুসলিম দেশ। রমজান তাই এখানে সংযমের মাস। কিন্তু ব্যবসায়ীরা নিজেদের লাভের ক্ষেত্রে কতটা সংযমী হচ্ছেন? বরং তাদের কাছে রমজান হচ্ছে অধিক মুনাফা লাভের মাস। মাহে রমজানের রোজা মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে চলার শিক্ষা দেয়। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ও আত্ম-অহংবোধ ভুলে গিয়ে সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার মাসই হলো রমজান। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এই সময়টাতেই মানুষকে ভালো খাওয়ানো, লাভ কম করে পণ্য বিক্রির মাধ্যমে সওয়াব কামানোর হিড়িক পড়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে রমজান এলেই পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। আবার একশ্রেণি অধিক লাভের নেশায় যেন মেতে ওঠে। তারা খাদ্যের শুধু অধিক মূল্যই নেয় না, বরং আরও লাভের আশায় ভেজাল মেশায়। তাহলে তারা আসলে ইসলামের কোন সংযম পালন করছেন?
প্রতি রমজানেই সরকার ঘটা করে মোবাইল কোর্ট নামায় জনসাধারণের খাবারের মান ঠিক রাখার চেষ্টায়। এরপর একে একে গণমাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় ভেজালের যে খবরগুলো আসতে থাকে তা আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে। ছোট, মাঝারি, বড়—কোনও জায়গায়ই খাদ্যের মান সঠিক ও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। তার অর্থ হচ্ছে আপনি রমজানে অল্প বা বেশি টাকা খরচ করেও এই নগরে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পাবেন না। অনেকেরই প্রশ্ন, শুধু রমজান কেন, নাগরিকদের খাদ্যমান নিশ্চিত করতে সরকার কেন সারা বছরই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে না? মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় থাকবে না কোনও রাজনৈতিক চাপ—সেটিও সরকারের নিশ্চিত করা উচিত।
ক্ষতিকর হওয়ায় সম্প্রতি ৫২টি পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত, যা পুরোপুরি সরিয়ে নেওয়া হয়নি এখনও। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে এসব ক্ষতিকর পণ্য এতদিন পর্যন্ত কীভাবে বাজারে ছিল। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাহলে কী কাজ করেছে? এতদিন এই ক্ষতিকর পণ্যগুলো খেয়ে নাগরিকদের যে শারীরিক সমস্যা তৈরি হয়েছে তার দায় তাহলে কে নেবে? আদালত পণ্যগুলো সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বক্তব্য কিন্তু আমরা পাইনি। যদি পণ্যগুলো ক্ষতিকর হয় তবে রাষ্ট্রের উচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া।
একজন আরেকজনকে ধারালো অস্ত্র বা গুলি করে হত্যা করলো। সেটি যেমন হত্যা তেমনি একজন ব্যবসায়ী বেশি মুনাফা লাভের আশায় খাবারে ভেজাল দিয়ে বিক্রি করে তিলে তিলে মানুষের শারীরিক ক্ষতি করে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। সেটাও কিন্তু এক ধরনের হত্যা। আবার এই হত্যাকারীর টার্গেট গ্রুপ নেই। তারা ভেজাল খাদ্যের মাধ্যমে সব বয়সীকেই অসুস্থ করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে। ফলে তার অপরাধ হত্যাকারীর চেয়েও অনেক বেশি। তাই খাদ্যে ভেজাল যারা দেয় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা উন্নত বাংলাদেশকে অনুভব করতে পারবো। এ বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গীকারও বিশেষ প্রয়োজন।
নাগরিক হিসেবে আমাদেরও সচেতন হতে হবে। ব্যবসায়ী শ্রেণি যদি এসব ভেজাল ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকেন তবে ভেজাল দেওয়ার সাহস তাদের কমে আসবে। যারা খাদ্যে ভেজাল দিয়ে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তারা কি ভেবে দেখেছেন আসলে তারা কাকে ঠকাচ্ছেন?
মাছে ভেজাল, মাংসে ভেজাল, ফলে ভেজাল, দুধেও ভেজাল, শাকসবজিতে ভেজাল। এসব খেয়ে আপনি যখন অসুস্থ হবেন তখন ওষুধ কিনতে গিয়েও কিনে আনবেন নকল ওষুধ। তা খেয়েই মৃত্যুর ঝুঁকি যাবে বেড়ে। মাছওয়ালা মাংস খায়, মাংসওয়ালা কেনে ফল আর মাছ, ফলওয়ালা দুধ কেনে, ওষুধওয়ালাও কেনে মাছ, মাংস আর দুধ। তাহলে কে কাকে ঠকাচ্ছে? কে কার ক্ষতি করছে?
লেখক: গবেষক
contact@salekkhokon.net