বিজেপির এখন অন্যতম টার্গেট হলো পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলের সরকার। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান নানা নাটকীয়তায় ভরা। করতেন কংগ্রেস। এরপর বনিবনা না হওয়ায় কংগ্রেস ত্যাগ করে নিজেই নতুন দল গঠন করেন তৃণমূল কংগ্রেস। তিনি তার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পদ দখল। পশ্চিমবঙ্গে বামশাসন যখন অনড় হয়ে বসেছিল, তখন মমতা চাইছিলেন আঘাতের পর আঘাত হেনে বাম দুর্গে ফাটল ধরাতে। পাষাণে মাথা কুটে শেষ পর্যন্ত তিনি সফল হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় তিন যুগের কমিউনিস্ট শাসন তছনছ করে দিয়েছেন মমতা। তিনি সাহসী ও বেপরোয়া। এই দুই গুণ সাময়িক জনপ্রিয়তা দিলেও রাজনীতিতে সফলতার জন্য দরকার কৌশল, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও সময়ের সঙ্গে চলার সক্ষমতা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা ধরে নিয়েছেন যে মানুষ বুঝি তাকে ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দিয়ে দিয়েছে। আত্মতুষ্টি ও দম্ভ তাকে উদ্ধত করে তোলে। তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তাচ্ছিল্য ও উপেক্ষা করতে থাকেন। বামপন্থীদের মতো তিনিও জোর যার মুল্লুক তার নীতি অনুসরণ করতে থাকেন। তার ধারণা হয়েছিল তিনিও বামপন্থীদের মতো ক্ষমতা কুক্ষিগত করে তার শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে পারবেন। তাকে ‘বধিবার’ শক্তি যে অলক্ষে বেড়ে উঠছিল, মমতা সেটা বুঝতে পারেননি।
এবার লোকসভা নির্বাচনে তিনি পশ্চিমবঙ্গের ৪২ আসন জয়ের লক্ষ্য নিয়ে প্রচারে নামেন। বিজেপি যে তার পায়ের নিচে সরিষা বিছিয়ে দেওয়ার কাজটি তলে তলে ভালোভাবেই করেছে সেটা বুঝতে পারেননি মমতা। যাদের তিনি দমন-পীড়নের মাধ্যমে ঠান্ডা রাখতে চেয়েছেন, তারা গোপনে কাতারবন্দি হয়েছে বিজেপির পেছনে। তাই নির্বাচনে বিজেপি দুই আসন থেকে ১৮ আসন পেয়ে যায়। আর মমতার দল ৩৪ থেকে নেমে আসে ২২-এ। মমতার তৃণমূলের শক্তিক্ষয় আর নরেন্দ্র মোদির বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি। এখন বিজেপি মমতার ঘরে হাত দিতে শুরু করেছে। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। বিজেপি-স্রোত ঠেকানোর কোনও পরিকল্পনা মমতার আছে বলে মনে হয় না।
বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে দল ভারী করার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই গত ৫ জুন বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন ‘বেদের মেয়ে জোস্না’খ্যাত অঞ্জু ঘোষ। তিনি কোনও রাজনৈতিক চরিত্র নন। তার অভিনয় জীবনের শুরু বাংলাদেশে। প্রথমে যাত্রা দলে, পরে বড়পর্দায় তিনি দাপট দেখাতে শুরু করেন। তিনি বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন দুই বাংলায় পৃথকভাবে নির্মিত ‘বেদের মেয়ে জোস্না’ ছায়াছবিতে ‘জোস্না’ চরিত্রে অভিনয় করে। অঞ্জু বাংলাদেশের মেয়ে। তিনি নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমার জন্ম ফরিদপুরে। তবে বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে’।
অঞ্জু ঘোষ বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় তার নাগরিকত্ব নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিজেপি বলছে, অঞ্জু ভারতের একজন ভোটার এবং গত নির্বাচনে তিনি ভোট দিয়েছেন। তিনি এখন ভারতীয় নাগরিক। অন্যদিকে তৃণমূল বলছে, বিজেপি কারসাজি করে বাংলাদেশি নাগরিককে দলের সদস্যপদ দিয়ে অনৈতিক কাজ করেছে। কলকাতার মেয়র ও তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিম টিটকারি করে বলেছেন, ‘দেশের মানুষ আর বিজেপিতে যোগ দিচ্ছে না, তাই ওপার বাংলা থেকে ওদের লোক নিয়ে আসতে হচ্ছে’।
অঞ্জু ঘোষ একসময় বাংলাদেশে ছিলেন। এখন তিনি ভারতীয় নাগরিক। তিনি প্রায় তিন দশক ধরে স্থায়ীভাবে কলকাতার সল্টলেকে বসবাস করছেন। তাকে যে বিজেপি দলে ভিড়িয়েছে সেটা মিছেমিছি বা ভুল করে নয়। পশ্চিমবঙ্গে অঞ্জু ঘোষের মতো অসংখ্য লোক আছেন। তাদের কেউ নাগরিকত্ব পেয়েছেন, কেউ পাননি। এরা কারও না কারও ভোট ব্যাংক। এই ভোটব্যাংক কব্জা করার জন্যই বিজেপি অঞ্জুকে দলে নিয়েছে। তার নাগরিকত্ব, জন্ম তারিখ নিয়ে যত বিতর্ক তৈরি করা হবে, তত বিজেপির লাভ। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে রাজনীতির দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন, তাদের এবার বিজেপি পক্ষে টানতে চায়।
বিজেপির এই কাজটি সহজ করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, মমতা যত ‘মুসলিমপ্রীতি’ দেখাবেন ততই হিন্দুরা বিজেপিমুখী হবে। বিজেপি এই ‘বিভেদের’ রাজনীতিটাই ক্যাশ করতে চায়। পশ্চিমবঙ্গে একসময় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিচর্চার জন্য সুনাম কুড়ালেও এখন পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে।
বিজেপি এই বিষয়টি হিসাবে নিয়েই পশ্চিমবঙ্গে ঝোলা নিয়ে নামছে। অঞ্জু ঘোষ বিজেপির একটি ‘টেস্ট কেস'। ভোটের প্রচারে তৃণমূল বাংলাদেশি অভিনেতাদের মাঠে নামিয়েছিল। ফেরদৌস, নূরকে দিয়ে কোন ভোটারদের প্রভাবিত করতে চেয়েছে তৃণমূল? তৃণমূলের দেখানো পথেই হাঁটছে বিজেপি। অঞ্জু ঘোষকে নিয়ে তৃণমূল যে বিতর্কই তুলুক–এতে লাভ বিজেপির। আর চোখের সামনে লাভ দেখে তা হাতছাড়া করার মতো নির্বোধের দল যে বিজেপি নয়, সেটা তারা এরইমধ্যে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।
লেখক: কলামিস্ট