ডিআইজি মিজান কি দুদকের চেয়ে ক্ষমতাশালী?






প্রভাষ আমিনপুলিশের দুই কর্মকর্তাকে নিয়ে তোলপাড় ছিল সারাদেশে। সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করতে ২০ দিন লেগেছে পুলিশের। মোয়াজ্জেম হোসেনের অপরাধটা গুরুতর। সোনাগাজী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল সিরাজ উদ্দৌলার যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর নুসরাত জাহান থানায় গিয়েছিলেন। ওসি মোয়াজ্জেম তাকে থানায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে আরেক দফা হয়রানি করেন এবং জানিয়ে দেন—কান্নাকাটি করার মতো কিছু হয়নি। নুসরাতকে অন্যায়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানি করার পুরো ঘটনা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। এই অপরাধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের দায়ের করা মামলায় অনেক জল ঘোলা করার পর ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর সেটা ফেনীতে গিয়ে পৌঁছানো নিয়েও হয়েছে অনেক নাটক।
গ্রেফতারি পরোয়ানা পাওয়ার বিষয়টি প্রথমে পুলিশ সুপার স্বীকারই করতে চাননি। স্বীকারের পর সেটি রংপুর পাঠালেন ভুল প্রক্রিয়ায়। এই টালবাহানার সুযোগে পালিয়ে গেলেন পুলিশের একজন ওসি! আমার ধারণা, পুলিশ তাদের এই সহকর্মীকে গ্রেফতার করতেই চায়নি। শেষ পর্যন্ত গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চাপে মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতারে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। তাদের মাথায় হয়তো বাহিনীর ভাবমূর্তি ও মনোবলের বিষয়টি ছিল। কিন্তু এ ধারণাটি মান্ধাতা আমলের। অপরাধীকে আড়াল করে রাখলেই বরং ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতারের পর বাহিনীর ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয়েছে। বাহিনীর কর্মীদের মনোবল আরও শক্ত হয়েছে। তবে ওসি মোয়াজ্জেমের অপরাধ নিছক নুসরাতের সঙ্গে তার কথোপকথন এবং তার ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া নয়। দাবি জানাচ্ছি, তাকে যেন নুসরাত হত্যা মামলায়ও আসামি করা হয়। কারণ, সিরাজ উদ্দৌলা গংয়ের মূল পরিকল্পনায় ছিল নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার পর সেটিতে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া। আর ওসি মোয়াজ্জেমই প্রথম এই অপচেষ্টাটি করেছিলেন। তিনি সেই গংয়েরই অংশ। তাই ওসি মোয়াজ্জেমকে নুসরাত হত্যা মামলায় আসামি করে তাকে সেই মামলায় গ্রেফতার দেখানোর দাবি জানাচ্ছি।

এক কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়ে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন, আরেক কর্মকর্তা সদর দফতরে বসে এক বছর ধরে পুলিশকে ডুবিয়ে যাচ্ছেন। অথচ ডিআইজি মিজানুর রহমানের যা অপরাধ, তাতে এক বছর আগেই তার গ্রেফতার হওয়া উচিত ছিল। নারী নির্যাতনের অভিযোগ মাথায় নিয়ে এক বছর ধরে তিনি বহাল তবিয়তে ‘ডিআইজিগিরি’ করে যাচ্ছেন। মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ বহুমুখী। ক্ষমতার অপব্যবহার করে দ্বিতীয় স্ত্রীকে হুমকি দিয়েছেন, জেল খাটিয়েছেন। এক সংবাদ পাঠিকাকে তিনি মেরে ৬৪ টুকরা করে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন। পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা একজন নারীকে মেরে ৬৪ টুকরা করে ফেলার হুমকি দেওয়ার পরও তিনি বহাল তবিয়তে থাকাটাই বরং পুলিশের জন্য গ্লানির।

এমন একজন মানুষ পুলিশের ডিআইজি পর্যন্ত হলেন কী করে! শুধু নারী কেলেঙ্কারি নয়, অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগও আছে ডিআইজি মিজান ও তার প্রথম স্ত্রী সোহেলিয়া আনারের বিরুদ্ধে। ডিআইজি মিজানের দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়েই বেধেছে নতুন গোল। তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন ডিআইজি মিজান। এই অভিযোগ কে করেছেন? ডিআইজি মিজান নিজেই। ঘুষ দেওয়াটাও যে অপরাধ, সেটা কি জানতেন না মিজান? আমার ধারণা জানতেন। কিন্তু যখন তিনি বুঝে গেলেন, তার বাঁচার আর কোনও উপায় নেই, ডুবে যাচ্ছেন—তখনই তিনি দুদককে নিয়ে ডোবার সিদ্ধান্ত নিলেন। অভিযোগ আনলেন দুদকের পরিচালকের বিরুদ্ধে।

এটিএন নিউজে প্রচারিত এই বিস্ফোরক অভিযোগ আসার একদিন পরেই দ্রুত তদন্ত কমিটি গঠন করে দুদক। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টের ভিত্তিতে দুদক খন্দকার এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করে। অবশ্য এনামুল বাছিরকে বরখাস্ত করা হয়েছে তথ্য পাচারের অভিযোগে, ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে নয়। যে অপরাধেই হোক, এনামুল বাছির কিন্তু সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। আর নারী নির্যাতন, হত্যার হুমকি, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, দুর্নীতি ঢাকতে ঘুষ—এমন বৈচিত্র্যময় নানা অভিযোগ করেও পুলিশ সদর দফতরে বসে আছেন মিজানুর রহমান একেই বলে ‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা’। ডিআইজি মিজানকে শুধু সাময়িক বরখাস্ত নয়, তার বিরুদ্ধে প্রত্যেকটি অপরাধে আলাদা আলাদা মামলা করাসহ তাকে গ্রেফতার করার কথা। সর্বশেষ অপরাধটির কথাই ভাবুন। তিনি নিজে দাবি করছেন দুদক পরিচালককে তিনি ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন। ঘুষ দেওয়াটাই এক নম্বর অপরাধ। দুই নম্বর অপরাধ হলো—তিনি ঘুষ দেওয়ার জন্য ৪০ লাখ টাকা কোথায় পেয়েছেন। অপরাধ নম্বর তিন—নিশ্চয়ই তার আয়বহির্ভূত বিপুল সম্পদ তো রয়েছে। যেটা দুদক জেনে গেছে। তাই সম্পদ ঢাকতেই তিনি ঘুষ দিয়েছেন। কত টাকা ঢাকতে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়? আগের অভিযোগ যাই হোক, নিজের মুখে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়ার কথা স্বীকার করার পরই তাকে বরখাস্ত ও গ্রেফতার করা উচিত ছিল। কারণ, এখানে তদন্ত করার কিছু নেই। যদি সত্যি সত্যি ঘুষ দিয়ে থাকেন, তাহলে সেটাই অপরাধ। আর যদি দুদক পরিচালককে ফাঁসাতে মিথ্যা বলে থাকেন,তাহলে মিথ্যা বলা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার দায়েও তিনি অভিযুক্ত হবেন।

কেন তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না, এ নিয়ে সবার প্রশ্ন। পুলিশ বলছে, তদন্ত চলছে। কিন্তু ‘আমি ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছি’ এটা বলার পর আর কী তদন্ত লাগবে, বুঝতে পারছি না। ‘তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’—এটা অবশ্য পুলিশের অনেক পুরনো কৌশল। যেকোনও কিছু ধামাচাপা দিতে চাইলে তদন্তের কথা বলে সময়ক্ষেপণ করা হয়। আর পুলিশকে বাঁচিয়ে দেওয়ার আরেকটি সহজ কৌশল হলো—ক্লোজড করা, যে ‘শাস্তি’ ডিআইজি এক বছর ধরে উপভোগ করছেন। আসলেই ডিআইজি মিজানের মতো দুর্নীতিবাজ অফিসারের জন্য ক্লোজড করা কোনও শাস্তিই নয়। কোনও কাজ করতে হবে না, কিন্তু বেতন পাবেন। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ডিআইজি মিজানের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, ‘যে ঘুষ দিয়েছে, যে নিয়েছে; দুজনেরই বিচার হবে।’ কিন্তু হয়নি।

শিরোনামে যে প্রশ্নটি,সেটিও আমার নয়, হাইকোর্ট দুদকের আইনজীবীর কাছে জানতে চেয়েছেন, ডিআইজি মিজান কি দুদকের চেয়ে ক্ষমতাশালী? প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যয়, হাইকোর্টের কৌতূহলের পরও ডিআইজি মিজানের কিছু হয়নি। এখন শুনছি তাকে সাময়িক বরখাস্তের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে ফাইল যাচ্ছে। তাও সেটা নারী নির্যাতনের অপরাধে। লালফিতার দৌরাত্ম্য বলে একটা কথা আছে। এবার হাতে-কলমে দেখলাম লালফিতা কাকে বলে। এক বছর আগের অপরাধে এখন বরখাস্তের ফাইল ওপেন হয়েছে। এখনকার অপরাধে ফাইল কবে ওপেন হবে, কে জানে। আমরা আবার ডিআইজি মিজানকে ওসি মোয়াজ্জেমের মতো পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছি না তো?

আমার কেবল একটাই প্রশ্ন, বহুমুখী অপরাধে জর্জরিত মিজানুর রহমান কি দুদকের চেয়েও শক্তিশালী?

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ