আমরা দুয়ো দেই। আমাদের সর্বোচ্চ জ্ঞান, সর্বোচ্চ মানবতা, সর্বোচ্চ প্রতিভা আমরা ব্যয় করি ধুয়ো দিতে। নিরাপদ দূরত্বে থেকে ধুয়ো দেই, কেউ আক্রান্তকে বাঁচাতে আসে না বলে। কেউ আক্রমণকারীকে থামাতে আসে না বলে। দুয়ো দেই, যারা দূয়ো দেয় তাদেরও। আমরা নিজে মানুষ কিনা যাচাই না করে প্রশ্ন তুলি অন্যরা মানুষ কিনা! এই চোখ বন্ধ করা প্রশ্নে আসলে মানুষ হারিয়ে যায়। কেউই আর মানুষ থাকে না। মানুষ হলে খুঁজে দেখতো, মানুষগুলো কেন এমন হয়ে গেলো। যে মানুষের মূল সৌন্দর্য ছিল প্রতিবাদে, প্রতিরোধে, সেই মানুষ কেন মুখ লুকায়? মানুষ কখন কেন উটপাখী হয়ে যায়?
সব সমাজে সব সময়ই অন্যায় ছিল। অপরাধ ছিল। অন্যায়-অপরাধকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইনের আবিষ্কার, বিচারের আবিষ্কার। আইন ও ন্যায় বিচার যখন স্বাধীনভাবে চলে, তখন অন্যায়-অপরাধ কমে আসে। উল্টোভাবে তাই যখন দেখা যায়, অন্যায় বেশি অপরাধ বেশি, তখন চোখ বন্ধ করে হলেও বুঝে নেওয়া যায়, আইন আর বিচার ঠিক নেই। আর এ দুটো ঠিক না থাকলে মানুষের সৎ সাহস কমে যায়। শেষ ভরসার জায়গা বলে যখন কিছু থাকে না। মানুষ তখন নিস্তেজ হয়ে যায়। মানুষ তখন গুটিয়ে যায়। মানুষের চোখের সামনে মানুষকে মানুষ কুপিয়ে মেরে ফেললেও মানুষের কিছু করার থাকে না। কারণ, মানুষ জানে, আইনের কাছে এ অপরাধীদের পরিচয় ‘অপরাধী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন। প্রশ্ন আসে, আইন কি গত কালের রিফাত, আগামী কালের যদু-মধু আমি আপনি কারও বিপক্ষে? আইন দিপন ভাই, অভিজিৎ, নুসরাত, তনু এরকম লম্বা নামের লিস্টে কার পক্ষে যে আইন, বোঝা মুশকিল।
এই মুশকিলে জনতা বিভ্রান্ত। বিভ্রান্ত জনতা তাই ঝামেলা এড়ায়, গা বাঁচায়। সমষ্টিগতভাবে কেউ কাউকে বাঁচানোর নেই বলে, মানুষ একলা বাঁচে। ঘাড় গুঁজে বাঁচে। মুখ বুজে থাকে। মরে বেঁচে থাকে। চারিদিকে সব মৃত মানুষের ভিড়। মনুষ্যত্ব মরে গেলেই কেবল সম্ভব খোলা রাস্তায় নিরস্ত্র মানুষকে কুপিয়ে লাশ করে ফেলা। মনুষ্যত্ব মরে গেলেই সম্ভব একের পর এক লাশের মিছিল দেখে ভুলে যেতে পারা। মনুষ্যত্ব মরে গেলেই প্রতিবাদ না করে দুয়ো দেওয়া সহজ হয়ে যায়। মনুষ্যত্ব মরে গেলেই সম্ভব বাস্তবের চরিত্রগুলোকে নিয়ে কাল্পনিক গল্প রচনা করে যেতে পারা। সত্য আর কল্পনা মিলে-মিশে এখন একাকার। সত্য নিয়ে বা ফ্যাক্ট নিয়ে আর মানুষ সন্তুষ্ট থাকে না। তাকে তাই কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়। বেঁচে থাকা এখন পুরনো শিশুপার্কের মেরি গো রাউন্ড। রঙিন প্লাস্টিকের ঘোড়ার পিঠে বসে ঘোড়ার কান ধরে ঘুড়ি আর ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক বাজে, আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী, সাথী মোদের লাল পরি।
কল্পিত লালপরী, নীলপরীর মতো আমরা কল্পনা করি, সুখ। আমাদের এই কল্পিত সুখের রাজ্যে কেউ দোষী নয়। দোষী শুধু হতভাগা জনগণ। যে রামদা দেখে আগায় না। যে বন্দুকের নল দেখে ঘরে দুয়ার দেয়। যে অন্যায়ের কবলে পড়ে। যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে দোষী সাব্যস্ত হয়। যে সত্য বললে গ্রেফতার হয়। যার ঘরে বিপদ, বাইরে বিপদ। কেন তারা এমন করে, এই প্রশ্নের উত্তর কেউ খোঁজে না। উত্তর খুঁজতে গেলে যে সত্যের মোকাবিলা করতে হয়, স্বঘোষিত পাণ্ডিত্যে তা মোকাবিলার শক্তি নেই তাদের। এজন্যই কেবল নিরাপদ দূরত্বে বসে এই সাধারণ মানুষগুলোকে তারা দুয়ো দেয়, জ্ঞান দেয়।
অহেতুক দোষের ভার নেওয়া এই হতভাগাদের বাদে আর যারা আছে, তাদের সব চরিত্র কাল্পনিক। এ দেশের সব মানুষ মৃত। রামদা বা চাপাতির কোপে, ক্রসফায়ারের গুলির ধাক্কায়, চলন্ত গাড়ির চাকায় পড়ে, ধর্ষকের নির্যাতনে লাশ হয়ে প্রমাণ করতে হয়, সে মরে নাই।
লেখক: উন্নয়নকর্মী