প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা বাংলাদেশের জন্য খুবই কঠিন। তবুও বাংলাদেশ গত ১০ বছর ধরে উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলে আসছে। কিন্তু এখন দিন দিন পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠছে। সুতরাং বাংলাদেশের পক্ষেও সম্পর্ক রক্ষায় তাল মেলানো জটিল। এ উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে ভারতসহ সব দেশেই আর্থিক দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সুতরাং আর্থিক প্রয়োজনে ধনী রাষ্ট্রগুলোর দ্বারস্থ হতে হয়।
ভারত মনে করে এই উপমহাদেশ তার প্রভাব বলয়ের মাঝে পড়ে। সুতরাং প্রতিবেশী দেশগুলো, যেমন- বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা তার কথামতো চলবে। কিন্তু ভারত তাদের আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করেছেন। তখন সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের কথাও চূড়ান্ত হয়েছিল। অর্থ সহায়তার ব্যাপারেও কয়েকটি চুক্তি হয়, যাতে ভারত ২ বিলিয়ন ঋণ প্রদান করতে পেরেছে। তার পরপরই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরে আসেন। আর চীনের প্রেসিডেন্ট প্রকল্প সহায়তা প্রদান করেন ২৪ বিলিয়ন ডলার।
ভারতের ঋণের টাকার ২০ শতাংশও এখনও পাওয়া যায়নি। আমাদের কর্মকর্তাদের মুখে শুনেছি ভারতের টাকা পেতে তাদের কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে অনেক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। নেপালও ভারতের ওপর চূড়ান্ত বিরক্ত। কারণ, নেপাল স্থলভূমি দ্বারা পরিবেষ্টিত। তার প্রয়োজনীয় সামগ্রী ভারত হয়ে নেপালে প্রবেশ করে। রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী তখন ভারত নেপালের ওপর একবার অবরোধ আরোপ করেছিল। এই অবরোধের কারণ ছিল রাজীব গান্ধীর সফরের সময় কাঠমান্ডুর প্রধান মন্দিরের পুরোহিতরা সোনিয়া গান্ধীকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেয়নি। যেহেতু তিনি খ্রিস্টান।
ভারতে এসে রাজীব গান্ধী এ রকম ঠুনকো বিষয়ে রাগ ঝাড়তে গিয়ে ছয় মাস নেপালে অবরোধ জারি করে রাখেন। আবার নরেন্দ্র মোদিও অবরোধ আরোপ করেছিলেন দীর্ঘ সময়ের জন্য। ২০১৫ সালে নেপাল যখন তার শাসনতন্ত্র চূড়ান্ত করছিল তখন প্রদেশসমূহের সীমানা পুনর্বিন্যাসের সময় ভারত বলেছিল তার সীমান্ত সংলগ্ন সমতল ভূমিতে একটি পৃথক প্রদেশ গঠন করতে। এই সমতল ভূমিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত লোকের বসবাস বেশি। নেপালের নেতারা তাদের এই অনুরোধ রক্ষা না করে পূর্ব-পশ্চিম এলাকাকে তিন ভাগে বিভক্ত করে অন্য প্রদেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। এতে নরেন্দ্র মোদির সরকার রাগ করে অবরোধ আরোপ করে।
এখন চীন নেপালে সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপন করেছে। নেপাল এখন আর ভারতের ওপর এককভাবে নির্ভরশীল নয়। বাংলাদেশ নেপালকে সৈয়দপুর বিমানবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে আর সৈয়দপুর বিমানবন্দর সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও নিয়েছে।
শ্রীলঙ্কার আর্থিক অবস্থা এখন ভালো নয়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত তামিলদের কারণে শ্রীলঙ্কায় ২৫ বছরব্যাপী যে গৃহযুদ্ধ হয় তাতে তার শিল্প কারখানা বিশেষ করে পোশাক শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। এখন নারিকেল তেল, রাবার আর চা রফতানির ওপর দেশটা নির্ভরশীল, যা দিয়ে ওই তাদের চলে না। সেই কারণে চীনের কাছ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার প্রকল্প ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কা তার হাম্বানতোতা বন্দর চীনকে লিজ দিয়েছে ৯৯ বছরের জন্য। এটি একটি পরিত্যক্ত বন্দর। বাণিজ্যিক কারণে তেমন ব্যবহার হয় না। চীন বন্দরের ব্যাপক সংস্কার করে নৌ-ঘাঁটি স্থাপনের ব্যবস্থা করেছে।
ভারত এখন প্রতিবেশীদের কাছে প্রচার করে বেড়াচ্ছে শ্রীলঙ্কা চীনকে ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় হাম্বানতোতা বন্দর দিয়ে নিয়েছে। অথচ ত্রিনকোমালি শ্রীলঙ্কার বাণিজ্যিক বন্দর। অবশ্যই তার প্রধান বন্দর হচ্ছে কলম্বো। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রতিবেশীদের প্রতি আচরণ কোনোটাই নিয়মিত নয়। চীন ও পাকিস্তান উভয় তার বৈরী। নেপালও তার আচরণে চূড়ান্ত বিরক্ত। ভুটানের দেশরক্ষা ব্যবস্থার ঠিকাদারি ভারতের। এখন চীনও সীমান্ত বিরোধের কথা বলে ভুটানে প্রবেশ করেছে। অবশিষ্ট বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক ভালো নয়। পানি নিয়ে বিরোধ লেগে আছে। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির পর বাংলাদেশ তাৎক্ষণিকভাবে বেরুবাড়ি ভারতকে হস্তান্তর করেছিল কিন্তু দীর্ঘ ৪২ বছর চুক্তি অনুসারে তার পাওনা ফেরত পায়নি। কারণ, লোকসভায় বিজেপি তার চূড়ান্ত বিরোধিতা করেছিল। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ২০১৫ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশে তার ছিটমহলগুলো পেয়েছে আর সীমান্ত প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে।
শেখ হাসিনা তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এবারও তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি কৌশলে পথ চলার নীতি অবলম্বন করে চলেন। অনেকবার সৎ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। জিয়াউর রহমানের সময় ফারাক্কার বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করে ছিলেন জিয়া। কিন্তু ভারতের চাপের মুখে তিনি তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। শেখ হাসিনা সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন এবং সব চাপ উপেক্ষা করে রায় পর্যন্ত লড়ে গেছেন। এখন ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে নির্ভেজাল সমুদ্রসীমা আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত হয়েছে। নিরুপদ্রব সীমান্তও দেশের অবগতির জন্য প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুরূপভাবে স্থল ও সমুদ্র সীমান্ত নিশ্চিত করে ফেলেছেন। এটা তার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় বাংলাদেশের বড় প্রাপ্তি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানত চীন সফরে গিয়ে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) গ্রীষ্মকালীন সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। এ সম্মেলন ডব্লিউইএফ সামার দাভোস হিসেবে পরিচিত। বছরে দুটি সম্মেলন হয়। শীতকালীন সম্মেলন হয় সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে আর গ্রীষ্মকালীন সম্মেলন হয় চীনে। এই ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈঠক হচ্ছে ১৯৭১ সাল থেকে। এখানে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধানরা, দুনিয়ার বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে বসে বিশ্বের আর্থিক ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয়ে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা করেন। এই সম্মেলনের উপকার হচ্ছে পরস্পরের সুবিধা-অসুবিধা উপলব্ধি করা হয়।
সম্মেলনের পরে উভয় দেশ নাকি আটটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে। আমাদের দেশে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শেষের পথে। এখন বিতরণের লাইন নির্মাণের প্রয়োজন। সুতরাং ট্রান্সমিশন, অনলাইন ট্রান্সমিশন স্টেশন ইত্যাদি নির্মাণের জন্য সম্ভবত চুক্তি স্বাক্ষর হবে।
‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ পরিকল্পনার সঙ্গে বাংলাদেশ এখনও রয়েছে। অবশ্য ভারত চীনের এই প্রকল্পের সঙ্গে নেই। সুতরাং ভারত চায় বাংলাদেশ যেন এ প্রকল্পের সঙ্গে না থাকে। অথচ ভারত সমস্ত বৈরিতা ভুলে চীনের সঙ্গে যদি এই প্রকল্পে থাকে তবে উভয় দেশ উপকৃত হয়। বাংলাদেশ চাপের মুখেও এ কথা বলেছে। ভারতের পিটিআই সংবাদ দিয়েছে, কলকাতা থেকে ঢাকা কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত সড়ক ও রেল যোগাযোগে এই প্রকল্পটি পুনরায় চীন জাগিয়ে তুলতে চাচ্ছে। এটা ত্রিদেশীয় বিষয়। প্রকল্পকে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড-এর অন্তর্ভুক্ত করতে চায় চীন। তবে ভারত তা মেনে নেবে না। এ প্রকল্পটির সঙ্গে সোনাদিয়া বন্দর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারত নাকি বন্দর করার বিরোধী। আশা করি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্ভয়ে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় অবিচল থাকবেন। ভারতের চোখ রাঙানিতে বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতি যেন উদাসীন না হন। বাংলাদেশের মানুষ তার পেছনে ঐক্যবদ্ধ।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com