কাশ্মিরে জবরদস্তি শাসন

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীভারতে বিজেপি সরকার কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে দিয়েছে। বিজেপির প্রতিটি নির্বাচনি মেনিফেস্টোতে ৩৭০ ধারা বাতিলের কথা সন্নিবেশিত থাকতো। প্রথমবার বিজেপি সরকার গঠন করেছিল অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে। দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৩০৩ আসন পেয়ে এককভাবে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে পুনরায় সরকার গঠন করে এবং নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হন। এবার বিজেপি কাশ্মিরে প্লট কেনার সুযোগ নিতে তাদের ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল, যা ভোট পেয়েছে শাসনতন্ত্র সংশোধন করতে তাদের কোনও বাধা বিপত্তি নেই।
সংবিধান প্রণয়নের সময়ও হিন্দু মহাসভার সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ৩৭০ ধারার বিরোধিতা করেছিলেন। তখন ৩৭০ ধারায় কাশ্মিরে কোনও ভারতীয় প্রবেশ করতে হলে পারমিট ভিসার প্রয়োজন হবে বলেও উল্লেখ ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে লোকসভার সদস্য মাওলানা হাসরাত মোহানীর সংশোধনী প্রস্তাবের কারণে পারমিট প্রথা বাতিল হয়েছিল। সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি কাশ্মিরে তার সমর্থক কিছু লোক নিয়ে ৩৭০ ধারার বিলুপ্তির দাবিতে পদযাত্রা করেছিলেন। ঝিলাম অতিক্রম করার পর যখন শ্যামাপ্রসাদ কাশ্মিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন তখন শেখ আবদুল্লাহ’র সরকার তাকে গ্রেফতার করেছিল। একটা ডাকবাংলোতে তাকে অন্তরীণ করে রেখেছিল। অন্তরীণ অবস্থায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মৃত্যু হয়।

৩৭০ ধারার বিরুদ্ধে থেকে বিজেপি তাদের পিতামহ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির আত্মত্যাগ সম্পর্কে কখনও বিস্মৃত হয়নি। বিজেপি মনে করে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে শেখ আবদুল্লাহ সরকার হত্যা করেছিল। সুতরাং বিজেপি তাদের পিতামহের এ দাবি পূরণের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। সোমবার ৫ আগস্ট ২০১৯ তারা তাই করেছে।

জম্মু, কাশ্মির, লাদাখ—এতদিন এই তিন অঞ্চল নিয়ে ছিল কাশ্মির রাজ্য। লাদাখ বৌদ্ধ অধ্যুষিত। কাশ্মির ছিল শতাংশে মুসলমান অঞ্চল। আর জম্মুতে হিন্দু, মুসলমান, শিখসহ মিশ্র জনসংখ্যা অঞ্চল, তবে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ অঞ্চলটা ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ শাসনের এলাকাভুক্ত ছিল। কিন্তু ১৮৪৬ সালে ইংরেজরা পঁচাত্তর লাখ রুপির বিনিময়ে গুলাব সিংয়ের কাছে বিক্রি করে দেয়। সে থেকে ডোগড়া রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারত বিভক্তির সময় হরি সিং ছিলেন ডোগড়াদের শেষ রাজা।

ভারত বিভক্তির সময় কাশ্মিরে শেখ আবদুল্লাহর কাশ্মির ন্যাশনাল কনফারেন্স ছিল জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। শেখ আবদুল্লাহ ন্যাশনাল কনফারেন্সের বর্তমান সভাপতি ফারুক আবদুল্লাহর পিতা। তখন কংগ্রেস, মুসলিম লীগের তেমন উল্লেখযোগ্য অস্তিত্ব কাশ্মিরে ছিল না। শেখ আবদুল্লাহ নিজেকে কাশ্মিরের জিন্নাহ মনে করতেন। শেখ আবদুল্লাহ পরিবারের সঙ্গে নেহরু পরিবারের সম্পর্ক ছিল কয়েক পুরুষ ধরে। মোরারজি দেশাই তো তার ‘মোরারজিস পেপার’ নামক গ্রন্থে শেখ আবদুল্লাহকে মতিলাল নেহরুর অবৈধ সন্তান বলে উল্লেখ করেছেন।

মহারাজ হরি সিং সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতেন। আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান ব্রিটিশ থেকে স্বাধীন হয়েছে। অক্টোবর পর্যন্ত তিনি কি পাকিস্তানের যোগ দেবেন না ভারতে যাবেন সে সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। অ্যালান ক্যাম্পবেল জনসন ছিলেন বড়লাটের সেরেস্তার উচ্চপদস্থ কর্মচারী। তিনি প্রত্যক্ষভাবে ভারত বিভাগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অ্যালান ক্যাম্পবেল তার লিখিত গ্রন্থ ‘মিশন উইথ মাউন্টব্যাটেন’-এ হরি সিং এবং হায়দ্রাবাদের নিজাম সম্পর্কে লিখেছেন, ‘যেমন কাশ্মিরের মহারাজ তেমনি হায়দ্রাবাদের নিজাম, বৃহৎ কোনও সংকটপূর্ণ অবস্থাকে প্রতিরোধ করার পন্থা জানেন না। জানেন শুধু দায়িত্ব এড়িয়ে কালক্ষেপণ করা। তাদের রাজনৈতিক বুদ্ধির ভান্ডারে এই দীর্ঘসূত্রতার কৌশলশাস্ত্র ছাড়া আর কোনও অস্ত্র ছিল না।’

কিন্তু তখন তো সেই কৌশল অবলম্বনের সময় ছিল না। কারণ পাঠান আর আফগান উপজাতির হাজার হাজার লোক কাশ্মিরের প্রবেশ করা শুরু করেছিল এবং তারা এত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল যে ২৮ অক্টোবর তারা রাজধানী শ্রীনগরে ৩৫ মাইলের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছিল। ডোগড়া ব্যাটালিয়ন তাদের প্রতিরোধ করতে পারছিল না।

কাশ্মির সম্পর্কে মাউন্টব্যাটেন এবং উপপ্রধানমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলের কোনও অস্পষ্টতা ছিল না। তারা মনে করতেন এটা যেহেতু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল সুতরাং তারা পাকিস্তানে যোগদান করবে। সর্দার প্যাটেল জুনাগর, হায়দ্রাবাদ নিয়ে যতই দুরভিসন্ধি করুক না কেন কিন্তু কাশ্মির নিয়ে তিনি ফন্দি-ফিকির করেননি। বরং তিনি লিয়াকত আলী খানকে বলেছিলেন নিজাম পাকিস্তানে যোগ দিতে চাচ্ছেন আর হরি সিং চাচ্ছেন ভারতে যোগদান করতে। সুতরাং এতে আমাদের হাতে উভয় রাজ্য একচেঞ্জ করার সুযোগ থাকবে এবং আমরা তাই করব।

কিন্তু নেহরু কাশ্মিরি ব্রাহ্মণ। তার অভিলাষ ছিল কাশ্মির ভারতের সঙ্গে থাকুক। এরই মাঝে হরি সিং ভারতের কাছে সৈন্য ও সমরাস্ত্র সাহায্য চাইলেন। নেহরু সৈন্য পাঠাতে উতলা হয়ে উঠলেন, কিন্তু গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেন বললেন হরি সিং আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের সঙ্গে যোগদান না করলে ভারতের সৈন্য পাঠানোর বিষয়টি তিনি অনুমোদন দিতে পারবেন না। হরি সিং ভারতে যোগদানের কথা ঘোষণা দেওয়ার পর গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন সৈন্য পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছিলেন এই শর্তে, কাশ্মিরে শান্তি ফিরে এলে গণভোটের আয়োজন করতে হবে এবং রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনুসারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। জাতিসংঘ বিরোধ মেটানোর জন্য গণভোটের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল।

এখন কাশ্মির তিন দেশের দখলে। লাদাখের কিছু অংশ চীনের দখলে। আবার কাশ্মিরের কিছু অংশ আজাদ কাশ্মির নামে একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তানের সঙ্গে আছে। বলা যায় পাকিস্তানের দখলে। অবশিষ্ট জম্মু ও কাশ্মির ভারতের শাসনতন্ত্রের ৩৭০ ধারা মোতাবেক এতদিন স্বায়ত্তশাসিত বিশেষ মর্যাদা ভোগ করা একটা রাজ্য ছিল। গত ৫ আগস্ট ২০১৯ ভারতের রাষ্ট্রপতি বিশেষ অর্ডিন্যান্স জারি করে ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করে জম্মু-কাশ্মির ও লাদাখে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করেছে। এখন থেকে কাশ্মির হবে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং দু’জন লেফটেন্যান্ট গভর্নর শাসিত এলাকা। জম্মু ও কাশ্মিরে বিধানসভাও থাকবে।

ভারতের অনেক নেতা সেদিন গভর্নর জেনারেলের গণভোটের প্রস্তাব গ্রহণ করতে চাননি। তখন ক্যাম্বেল তার বইতে লিখেছেন মাউন্টব্যাটেন নাকি নেহরুকে বলেছিলেন, ‘ভণ্ডামি করে রাষ্ট্র গঠন করা যায় না।’ কাশ্মির নিয়ে নেহরুর ভণ্ডামির ইতি টেনে নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বার পর্দা তুললেন। শেষ পর্যন্ত মাউন্টব্যাটেনের কথাই সত্য প্রমাণিত হবে—‘ভণ্ডামি করে রাষ্ট্র গঠন করা যায় না’।

গত ৭০ বছর ফিলিস্তিনে শান্তি স্থিতি কিছুই নেই। যেখানে শান্তি-স্থিতি কিছুই নেই, সেখানে তো রাষ্ট্র গঠন বৃথা। আর কাশ্মিরেও তো শান্তি স্থিতি কিছুই নেই। এখানে কি উল্টাপাল্টা করে শান্তি স্থিতি কিছু আনা যাবে! দোভাল ডকট্রিন বলছে, ব্যাপক অবসরে যাওয়া সামরিক বাহিনীর পরিবারগুলোকে বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করা হবে কাশ্মিরে। দেখা যাক কী ফল দেয়।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com