ঈদুল আজহা ‘কোরবানির ঈদ’ নামেই বেশি পরিচিত। ঈদুল ফিতরের সময় যেমন নতুন পোশাকের বিষয়টি গুরুত্ব পায়, কোরবানির ঈদে তা নয়। এ ঈদে প্রধান বিষয় পশু- গরু কিংবা ছাগল। আজকাল অবশ্য আমাদের দেশে উটও আমদানি হচ্ছে। তবে আমাদের দেশে গরু-ছাগলই প্রধানত ঈদুল আজহায় কোরবানি দেওয়া হয়। এই কোরবানি দেওয়া হয় মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য। পশু কোরবানি দিয়ে আসলে মানুষের ভেতরে যে পশুত্ব আছে তাকে বর্জন করার কথাই বলা হয়। কোরবানির ঈদে আত্মত্যাগের মহিমা তুলে ধরা হয়। মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যাবে, স্বার্থপর হবে না, কারও ক্ষতি করবে না, পরোপকারী হবে, নিজের সুবিধার জন্য অন্যকে বিপদে ফেলবে না– এগুলোই মূলত কোরবানির তাৎপর্য বলে মনে করা হয়। কেউ কেউ এমনও বলেন, বনের পশুকে কোরবানি দিয়ে মানুষ আসলে মনের পশুকে বশ মানাতে চায়।
দেশের অবস্থা দেখে কী মনে হয় কোরবানির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ব্যাপকভাবে মানুষের মধ্যে কাজ করছে? একসময় বলা হতো ধর্ম হলো মানুষের ভেতরের জিনিস, যা তাকে ধারণ করে আছে সেটাই ধর্ম। নিজের আত্মশুদ্ধির জন্য, আত্মসংযমের জন্য, আত্মসুখের জন্য ধর্ম পালন। এটা কাউকে দেখানোর জন্য নয়। প্রচার ও প্রদর্শন ধর্মের মূল বিষয় নয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। মানুষ এখন যা করে সবই দেখানোর জন্য, প্রচারের জন্য। ধর্মও তার বাইরে নয়। তাই এখন ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ও আড়ম্বর বাড়ছে। রোজা-নামাজ-হজ সবই হচ্ছে। অধিক সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণও করছে। অন্য ধর্মানুসারীদের মধ্যেও ধর্ম পালনের আগ্রহ বাড়ছে। এই যে মানুষের ধর্মে মতি, এটা তো ভালো লক্ষণ। আগে শুনতাম ধর্মকর্ম থেকে মানুষ দূরে সরে গেলে নাকি দেশে এবং সংসারে নানা অশান্তি, দুর্যোগ-দুর্বিপাক আসে। এখন তো মানুষ ব্যাপকভাবে ধর্মমুখী, ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে উপচেপড়া ভিড়। কিন্তু মানুষের মনে বা ঘরে শান্তি বাড়ছে কি? মানুষ কি সব নিয়ে সুখী? দেশে কি শান্তি আছে? যেভাবে চলার কথা সেভাবে কি চলছে দেশ?
এই যে দেশে সুশাসন নেই বলে আমাদের এত অভিযোগ-অনুযোগ, কারা এর জন্য দায়ী? তারা কি ধর্মানুরাগী নন? তারাও নিশ্চয়ই এবার ঈদের জামাতে নামাজে শরিক হয়েছেন, কোরবানি দিয়েছেন গরু কিংবা খাসি। সবচেয়ে দামিটাই হয়তো দিয়েছেন। তাহলে? কারা ঘুষ-দুর্নীতি করছে, কারা করছে নারী-শিশু নির্যাতন-ধর্ষণ? কী করে দেশের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে? গলদ কোথায়, সমস্যাটা কোথায়?
ঈদ বা অন্য কোনও উৎসব আয়োজনে অংশ নিয়ে আমরা সব সময় গৎবাধা কিছু কথা বলি। অবশ্য আজকাল কেউ আর সৎ পথে থাকার বা সৎ চিন্তা করার পরামর্শ দেন বলে মনে হয় না। এখন আমাদের মনে এক, আর মুখে আরেক। এখন হলো আখের গোছানোর যুগ। সর্বগ্রাসী লোভ আমাদের পেয়ে বসেছে। লোভের নেশায় মত্ত মানুষ কেবল পাওয়ার জন্য ছুটছে। পেতে হলে যে দিতেও হয়, এটা এখন আর আমাদের মনে থাকে না।
এবার ঈদের আগে যদি দেশের ২৮টি জেলার ৬০ লক্ষাধিক মানুষ বন্যাকবলিত না হতেন, বন্যায় যদি শতাধিক মানুষের মৃত্যু না হতো, যদি পাঁচ লাখেরও বেশি ঘরবাড়ির ক্ষতি না হতো, যদি দেড় লাখ একরের বেশি ফসলি জমি পানিতে না ডুবতো তাহলে ঈদের আনন্দ নিঃসন্দেহে আরও একটু বেশি হতো।
এবার ঈদের আগে যদি রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে না পড়তো , যদি ডেঙ্গুতে সচ্ছল পরিবারের এতগুলো মানুষের মৃত্যু না হতো, ডেঙ্গুটা যদি ঢাকায় আরম্ভ হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে না পড়তো, তাহলে ঈদের আনন্দ এবং উদযাপন আর একটু ভালো হতো, উৎসাহ-উদ্দীপনা হয়তো আরও একটু বেশি হতো। তবে বন্যা-ডেঙ্গু আমাদের জীবনকে যেমন স্থবির করতে পারেনি, তেমনি ঈদ উদযাপনকেও বাধাগ্রস্ত করেনি।
কোনও ঈদেই সব পরিবারে সমান আনন্দ হয় না। এবার হয়তো একটু বেশি পরিবার শোক ও কষ্টে আছে, তারপরও ঈদ এলো ঈদের নিয়মেই। আমরা বলে থাকি, ঈদ জামাতে ধনী-গরিব, ছোট-বড়-নির্বিশেষ সব মুসলমান ভেদাভেদ ভুলে কাতারবন্দি হয়, এটা ঠিক। ঈদ জামাতে নামাজ শেষে গলাগলি, কোলাকুলি মানে এই নয় যে আমরা ভেদাভেদ ভুলেছি, বৈষম্য ভুলেছি। বরং আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, আমাদের দেশে ধনবৈষম্য প্রকট হচ্ছে। ধনী আরও অধিক সম্পদের মালিক হচ্ছে। গরিব বেঁচে থাকছে, নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। একশ্রেণির মানুষ উৎকট ক্ষমতাবান হচ্ছে আর বিপুল জনগোষ্ঠী হচ্ছে ক্ষমতাহীন, অধিকারহীন। সামাজিক বৈষম্য নিরসনে ঈদের ভূমিকা থাকার কথা ছিল। ধর্মীয়ভাবেই এই বৈষম্য আমাদের নিরসন করার কথা ছিল। কিন্তু সেটা কি সম্ভব হচ্ছে?
লেখক: কলামিস্ট