কাশ্মির ও বাংলাদেশ





আনিস আলমগীরঈদ মানেই আনন্দ। কাশ্মিরে এবার ঈদ আনন্দ আসেনি। সেখানে ঈদ আনন্দ দূরে থাক স্বাভাবিক দিন কবে আসবে সেটা নিয়েই এখন নানা প্রশ্ন। কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ পর গোটা কাশ্মির উপত্যকায় সোমবার পবিত্র ঈদুল আজহা পালিত হয়েছে কারফিউর মধ্যে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা আর কঠোর কারফিউর মধ্যে এই ঈদ উদযাপনকে অনেকে তুলনা করছেন ১৯৭১ সালের বাংলাদেশিদের দুটি ঈদ উদযাপনের সঙ্গে। ভারতীয় লোকসভার সদস্য আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ৩৭০ ধারা বাতিলের প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ভারত সরকার কাশ্মিরিদের কোরবানির আগেই কোরবানি দিয়েছে।
কাশ্মির উপত্যকা থেকে বিবিসি’র সংবাদদাতারাও জানাচ্ছেন, জামিয়া মসজিদ বা হজরতবালের মতো প্রধান মসজিদগুলোতে কোনও বড় ঈদের জামাতের অনুমতি দেওয়া হয়নি। বিবিসি’র খবরে বলা হয়েছে, শহরের রাস্তাঘাট ছিল প্রায় জনশূন্য, মোবাইল-ল্যান্ডলাইন বা ইন্টারনেট সেবা এখনও চালু হয়নি। শ্রীনগর থেকে ঈদের দিন সকালে বিবিসি জানিয়েছে, গত দুদিন ধরে শহরে কারফিউ যে অল্প কিছুটা শিথিল করা হয়েছিল, তা ঈদের দিন সকাল থেকেই ফের উধাও।
কিন্তু কেন আবার নতুন করে এই কড়াকড়ি, সরকারি কর্মকর্তারা তার কোনও জবাব দিচ্ছেন না। তারা দাবি করছেন, কোনও কারফিউ নেই, শুধু নিয়মটা হলো চারজনের বেশি লোক একসঙ্গে এক জায়গায় জড়ো হতে পারবেন না। অথচ রাস্তায় দেখা যাচ্ছে পুলিশের গাড়ি মাইকিং করে বেড়াচ্ছে, কেউ যেন কারফিউতে বাড়ি থেকে না বের হয়। ইউগিতা লিমায়ের কথায়, সব মিলিয়ে যেন একটা পরস্পরবিরোধী বার্তা দেওয়া হচ্ছে।
ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার গত ৫ আগস্ট ২০১৯ সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ ও ৩৫এ অনুচ্ছেদ বাতিল করে দিয়ে জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যকে কেন্দ্রীয় শাসনের অন্তর্ভুক্ত করেছে। ৩৭০ ধারা শুধু সংবিধানের অংশ নয়, এটি কাশ্মিরের আঞ্চলিক স্বাধীনতার গ্যারান্টি। এটিকে ভারত তার অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে চালাতে চাইলেও বিশ্ববাসীর সবাই মানতে নারাজ। এমনকি তার দেশের মানুষরাও কনভিন্সড না। কারণ, ৩৭০ ধারার সঙ্গে কাশ্মিরের আঞ্চলিক স্বাধীনতার জড়িত। তাদের নিজস্ব পতাকা রয়েছে। দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং যোগাযোগ ভারত সরকারের হাতে। লোকসভায় কোনও আইন কাশ্মিরে চালু হবে না যদি এই আইন কাশ্মির বিধানসভায় গৃহীত না হয়। কাশ্মিরে ভারতের অন্য অঞ্চলের লোক সম্পত্তি কিনতে পারে না, স্থায়ীভাবে বসতি করতে পারে না।
বিরোধীরা অভিযোগ করছেন, নরেন্দ্র মোদি কাশ্মিরের আঞ্চলিক স্বাধীনতাকে হরণ করে ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মিরকে একীভূত করেছেন। এটি কখনও তাদের সংবিধানের চেতনার সঙ্গে যায় না। জোর যার মুল্লুক তার, এমন ক্ষমতা খাটিয়ে কাশ্মিরকে তার আঞ্চলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
কাশ্মিরের বিষয় নিয়ে এই উপমহাদেশে উত্তেজনা বিরাজ করছে। বাংলাদেশ এই উত্তেজনার বাইরে নয়। পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নামিয়ে এনেছে। সব বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে। সব চুক্তিও বাতিল করার কথা বলছে। ভারত পাকিস্তানকে অনুরোধ জানিয়েছে সব সম্পর্ক বহাল রাখার জন্য। ভারতের অভ্যন্তরেও নরেন্দ্র মোদির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে। দিল্লিতে বিক্ষোভ করেছে সিপিএম। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কংগ্রেস নেতা গোলাম নবী আজাদকে কাশ্মিরের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। শ্রীনগর বিমানবন্দর থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কলকাতায় গত বুধবার বৃহত্তম বিক্ষোভ হয়েছে। পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, তৃণমূল কংগ্রেস কাশ্মিরিদের সঙ্গে রয়েছে। কংগ্রেসও কাশ্মিরিদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে।
পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরেও প্রচণ্ড বিক্ষোভ হয়েছে। পাকিস্তান এখনও বলছে তারা কোনও সামরিক অ্যাকশনে যাচ্ছে না। তবে পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়বা, জইশ-ই মোহাম্মদ খুবই দুর্ধর্ষ প্রকৃতির সংগঠন। আত্মঘাতী হামলায় তাদের কুখ্যাতি আছে। সম্ভবত তারা এখন ভারতের অভ্যন্তরে সক্রিয় হয়ে আত্মঘাতী হামলা চালাবে।
তবে বিশ্ববাসী উদ্বিগ্ন পাকিস্তান এবং ভারতের মাঝে কাশ্মির নিয়ে কোনও যুদ্ধ বেঁধে যায় কিনা- যেহেতু উভয় রাষ্ট্রের কাছে আণবিক অস্ত্র রয়েছে। কাশ্মির নিয়ে বড় ছোট চারবার যুদ্ধ হয়েছে তাদের মধ্যে। মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট মাহাথির মোহাম্মদ কাশ্মিরের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল এবং কাশ্মিরিদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তুরস্ক এবং ইরানও সহানুভূতিশীল। তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুসলিম বিশ্বের দুর্দশাগ্রস্ত অঞ্চলকে সাহায্য করার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালালে হয়তো কোনও শান্তির উপায় আসতে পারে। কাশ্মিরের নাজুক পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই তারা কোনও একটা পজিটিভ সিদ্ধান্ত নেবেন।
কাশ্মিরে নিরাপত্তাহীনতা ও হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে ভারত ও পাকিস্তানকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে রুহানি এ আহ্বান জানান। রুহানি আরও বলেন, কাশ্মিরের মুসলিমদের স্বার্থরক্ষায় তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে শান্তিতে বসবাসের সুযোগ করে দিতে হবে। সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে কাশ্মির সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সেখানে কূটনৈতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর আগে একবার ভারত সফরের সময় বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নাকি স্বামী স্ত্রীর। সরকার ‘গভীর পর্যবেক্ষণ’ শেষে কী প্রতিক্রিয়া দেয় জানার অপেক্ষায় অনেকে।
বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে ৩৭০ ধারা বাতিলের বিরুদ্ধে বামপন্থী এবং ইসলামিক দলগুলোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সরকার নিশ্চুপ থাকলেও সাধারণ মানুষ উত্তেজিত। ইসলামিক দলগুলো বিশেষ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম সবচেয়ে বেশি তৎপরতা চালাচ্ছেন। তারা এযাবৎ কয়েকটা বড় মিছিল করেছেন। ইসলামী দলগুলো সম্মিলিতভাবে একটা কর্মসূচি দিলে হয়তো চোখে পড়তো। বাম দলগুলোও অনুরূপ কিছু করতে পারতো। বিএনপি, আওয়ামী লীগ তো কোনও প্রতিক্রিয়াই জানায়নি।
কাশ্মির নিয়ে প্রতিক্রিয়াকে অনেকে সহজভাবে নিচ্ছে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম চরমোনাই পীরকে নিয়ে ট্রল হচ্ছে। কারণ,তিনি বলেছেন, কাশ্মিরের জন্য প্রয়োজনে জীবন দেবেন। যারা ট্রল করছেন তারা হয়তো অন্যের মত সহ্য করার ক্ষমতা রাখেন না বা শত ফুল ফুটতে দেওয়ার সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী না। সব মতকে সহ্য করার ক্ষমতা সুস্থ সমাজের লক্ষণ। যেখানে মত প্রকাশে বাধা আছে সেটি অসুস্থ সমাজ। এর বিস্ফোরণ যখন হয় তা হয় ভয়াবহ।
চরমোনাই পীর জীবন দিতে চাইলে আপনার সমস্যা কি! দিতে দেন কিন্তু এই নিয়ে আমাদের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো বা ভারতের বিরুদ্ধে সম্পর্ক নষ্ট হয় এমন আগ্রাসী কর্মসূচি যাতে না দেন সেটা বলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও বিষয়টা সেভাবে দেখতে হবে। আপনারা কি জানেন, পাকিস্তান অধ্যুষিত কাশ্মিরও দখল করবেন এবং প্রয়োজনে জীবন দিবেন বলে ঘোষণা করেছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ? তিনি এবং চরমোনাই পীর কেউ জীবন দিবেন না, এটা কথার কথা।
বাংলাদেশের মানুষ ম্যান্ডেলার মুক্তি চেয়ে মিছিল করেছেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকার সৈন্যদের ভিয়েতনাম থেকে প্রত্যাহারের জন্য মিছিল মিটিং করেছে। ফিলিস্তিন নিয়ে মিটিং মিছিল করেছেন। ইরাক কিংবা আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রসন নিয়েও মানুষ রাস্তায় নেমেছে। নির্যাতিত মানুষের পক্ষে ভূমিকা রাখা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও মানুষেরা ঐতিহাসিকভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করেন।
ভারত বাংলাদেশের বন্ধু এবং বৃহত্তর প্রতিবেশী তা সত্য। আবার ভারত অসন্তুষ্ট হলে বাংলাদেশের জন্য বহু সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ অনুরূপ সমস্যা গত ৪৮ বছর ধরে মোকাবিলা করে আসছে। বাংলাদেশ ছোট দেশ। তাই বলে নতজানু হয়ে থাকবে তা তার জনগণ আশা করে না। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় সিকিমকে ভারত নিজেদের করে নিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদি কাশ্মিরের আঞ্চলিক স্বাধীনতা হরণ করেছেন- এসব বাংলাদেশের মানুষ ভালো চোখে দেখে না। বরং মোদি-অমিত শাহ জুটির নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ শঙ্কিত।
যাক, ৫ আগস্ট ২০১৯ তারিখ কাশ্মিরের ৩৭০ ধারা বিলোপের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদি ভারতের স্বর্ণযুগের সূচনা করলেন নাকি গর্বাচেভের হাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মতো তিনি ভারত ভাঙার দ্বার উন্মোচন করলেন- সেটা ভবিষ্যৎ বলে দিবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
anisalamgir@gmail.com