২০০০ সাল থেকে ২০১৯। আলফ্রেড সরেন হত্যার ১৯ বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এখনও বিচার পায়নি শহীদ আলফ্রেড সরেনের পরিবার। আলফ্রেড জীবন দিয়েছিলেন ভূমিকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু সেই ভূমি রক্ষা করতে গিয়ে, তাকে জীবন দিতে হয়েছে। সেই ভূমির ওপরই তাকে হত্যা করা হয়েছে। সেই হত্যার বিচার করার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের। সেই বিচার তো হয়নি, বরং আজও ‘আদিবাসী’দের হত্যার স্বীকার হতে হচ্ছে নিজ ভূমি রক্ষার জন্য। সমতলের শুধু আলফ্রেড সরেনই নয়, পিরেন স্নাল, গিদিতা রেমা, চলেশ রিছিলের মতো সাহসী ‘আদিবাসী’ জীবনগুলো যখনই তাদের উচ্ছেদের প্রতিবাদ করতে গেছে, জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ‘উন্নয়ন’কে বুক দিয়ে ঠেকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, সেই জীবনগুলোকে জিইয়ে রাখা হয়নি, তখনই তাদের হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যার কোনোটিরই সঠিক বিচার আজও হয়নি।
আলফ্রেড সরেনের মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। তবে যতদূর জানা গেছে, আসামিরা জামিনে বের হয়ে বিভিন্ন সময়ে আলফ্রেড সরেনের পরিবার ও সাক্ষীদের হুমকি দিয়ে চলছে। এই হুমকির ভয়ে আলফ্রেডের পরিবার এবং সেই এলাকার অন্যান্য সাঁওতাল পরিবারগুলোর অনেকেই ইতোমধ্যে সেখান থেকে অন্যত্র চলে গেছে। কেউ কেউ টিকতে না পেরে দেশও ত্যাগ করেছে।
এখানেই শেষ হয়নি নিত্য ভূমি অধিকারের দাবি পাড়া বিপরীতে নিপীড়নের অভিজ্ঞতা। আমরা জেনেছি কীভাবে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকলের জমি দখলকে কেন্দ্র করে সাঁওতালদের বসতিতে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট এবং আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ সময় প্রাণ যায় তিনজন সাঁওতালের। এই সহিংসতায় উচ্ছেদ হওয়া এবং প্রতিদিন ভয়ের মধ্যে থাকা সাঁওতাল পরিবারগুলো আশ্রয় নেয় মাদারপুর ও জয়পুরপাড়া গ্রামের খোলা আকাশের নিচে। সেখানেই ঝুপড়ি ঘর করে আবারও জীবন শুরু করেছে দুই শতাধিক সাঁওতাল পরিবার। ভয় এবং আতঙ্কে মোড়া জীবনগুলো একটু একটু করে আবারও জীবনের প্রতি টান টান করে দাঁড়াতে চেয়েছে। অবাক করা বিষয় হলো, গত আড়াই বছর ধরেই তারা এভাবে আছে।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লি থেকে এই উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতালরা আড়াই বছরেও বাপ-দাদার ভিটা ফিরে পাননি। গোবিন্দগঞ্জের ঘটনা মিডিয়ায় বড় ধরনের নড়াচড়া ফেললেও পরবর্তী সময়ে সাঁওতালদের পুনর্বাসনের কোনও ধরনের উদ্যাগ নেওয়া হয়নি।
তবে এই সহিংসতার পরপরই অভিযোগ ওঠে, পুলিশের উপস্থিতিতেই একটি বিরোধপূর্ণ জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদের সময় তাদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেই ঘটনার ভিডিও তখন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। তবে বিচার বিভাগীয় এবং পুলিশের বিভাগীয় তদন্তেও এই ঘটনায় পুলিশের সংশ্লিষ্টতার বিষয় প্রমাণিত হয় এবং তা গণমাধ্যমে আলোচিত হয়। শুধু তাই নয়, তদন্তের পর পুলিশের পক্ষে থেকে দুটি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। অভিযুক্ত পুলিশদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।
তারপর কীভাবে যেন অনেক কিছু পাল্টে গেল। এতো কিছুর পরও, এমনকি ভিডিওতে দেখা গেলেও, আগুন লাগানোর অভিযোগ পুলিশ বিভাগ থেকে বারবার অস্বীকার করা শুরু হলো। তবে হাইকোর্টের আদেশের পর অবশেষে দুই পুলিশ সদস্যকে শনাক্ত করা হয়েছিল সেই সময় এবং তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
তারপর হঠাৎ করে কিছুদিন আগে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে তা প্রত্যাখ্যান করে বিক্ষোভ করছেন সাঁওতালরা, কারণ সেখানে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনা হয়নি। শুধু তাই নয়, তারা আরও অভিযোগ করে বলেন সেই ঘটনার পেছনে একজন রাজনৈতিক নেতা জড়িত ছিলেন, তাকেও চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এভাবেই ঘটনাগুলো পাল্টে যায়, নিপীড়িতের জীবন বিবর্ণ হয়, আর আমাদের সামনে খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসে কিছু অতি ‘গোপনীয়’ সত্য।
আলফ্রেড সরেন থেকে শুরু করে সকল ভূমি যোদ্ধাদের হত্যার পেছনে যে বড় কোনও রাজনৈতিক শক্তির ভিত্তি আছে যা স্পষ্টতই বোঝা যায়। এই বিশ্বাসের খুঁটি আরও মজবুত হয়ে পড়ে যখন আমরা দেখি কোনও হত্যাকাণ্ডেরই বিচার হয় না। বরং সেই পরিবার এবং সেই এলাকার মানুষেরা ভয়ের সংস্কৃতির কাছে বন্দি হয়ে যায়, আবার কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারে না, দেশান্তরী হয়।
এই উপমহাদেশে ভূমিকে রক্ষার জন্য প্রথম তীর ধনুক হাতে নিয়েছিল সাঁওতাল জনগণ। সেই ভূমি রক্ষার লড়াই আজও তাদের করতে হয়। তবু ভূমি রক্ষা হয় না। শুধু তাদের জীবনটাই নিয়ে যায় কারা যেন?
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: zobaidanasreen@gmail.com